আল্লাহর কাছে আসার গল্প-১


আল্লাহর কাছে আসার গল্প-১





আমাদের ক্যাম্পাসে ইংলিশ পড়ানোর জন্য একজন নতুন টিচার নিয়োগ করা হয়েছিল। স্টুডেন্ট দের মাঝে উনার ভালই জনপ্রিয়তা ছিল, কারণ উনি আমেরিকার নামকরা একটা ব্যান্ডে গান গাইতো। বর্তমানে দেশে আছে; তবে এখনো ব্যান্ডের সাথে যুক্ত বলেই জানতাম। এসব রং তামাশা আমার বরাবরই অপছন্দ। আমার মত প্রত্যেকটা আল্লাহ ভীরু মানুষরাই এরকম সঙ্গীতশিল্পীদের কম দেখতে পারে। আর অশ্লীল গানবাজনা হলে তো কথাই নেই! নতুন শিক্ষিকার আগমনের ৭ দিন আগ থেকেই তার ব্যাপারে আপত্তিকর সব কিছু শুনে আসছিলাম।
.
সেদিন পুরো ক্লাস ফিল আপ ছিল। সবার মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। অনেকের আইডল সে! ইংলিশ ক্লাসের আগে সবার মাঝে ম্যাম কে নিয়ে কথা চলছে... সে অবস্থায় দরজায় ঠকঠক শব্দ হল। রোরকা পরা একজন মহিলা ঢুকে টেবিলে তার ব্যাগ ও ফাইল রেখে বলল - "Assalamu alaykum students. A very good morning to you all. I am your new english teacher. Many of you may know me already, some you don't..." এভাবেই শেষ হল পরিচিত হওয়ার অধ্যায়। পুরো ক্লাস জুড়ে অবাক হয় নি- এমন কোন ছেলে মেয়ে ছিল না। বাকি সময় নিস্তব্ধতায় পার হল। ২/১ দিন ক্লাস করার পর ম্যাম একদিন হঠাৎ হেসে বলল - "Why am i seeing so many blank faces? Are you having any trouble with my way of teaching?" আমরা সবাই না বললাম। আমাদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল (উনার ভক্ত), সে হাত তুলে বলল - "ম্যাম, আপনার ব্যাপারে অনেক বেশি কিছু আশা করছিলাম। বাট আপনি এরকম কীভাবে কি? এখানে অনেক ফ্যান আছে আপনার। হঠাৎ কি হল??" উনি অন্য কোনদিন জানাবেন বলে কেটে পড়লো।
.
আমরা সবাই মিলে বেশ কয়েকবার জোর করার পর অবশেষে ম্যাম রাজি হল। সেদিন ছিল আমাদের জীবনের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন! আমরা ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম উনার কথা রেকর্ড করতে (যদিও পরে অনুমতি পাই নি)। অত:পর ম্যাম সব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া শুরু করলেন...

আজ থেকে ১০ মাস আগে একদিন আব্বু বলল হজ্জ করতে যাবে। আমার এসব ধর্মীয় কার্যক্রম কখনোই ভাল লাগতো না। বরবর, ব্যাকডেইটেড ও আজগুবে মনে হত। হজ্জে যাওয়ার জন্য যখন বেশি জোরাজোরি করছিলো, আমি রাগান্বিত হয়ে ১০ টা মদের বোতল আব্বুর সামনে ভেঙে চুরমার করে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। পরে ৪ দিন আমার বয়ফ্রেন্ডের বাসায় থেকেছি ফ্যামিলির সাথে কন্ট্যাক্ট অফ করে। পঞ্চম দিন আম্মু ফোন করে অনেক বুঝিয়ে বাসায় আনলো আমাকে। তারপর ইমোশনালি বুঝালো তাদের সাথে সৌদি যেতে। আমি ইউটিউবে সৌদি আরব দেখতে শুরু করলাম। সেখানকার খাবারদাবার, ঘুরার যায়গায় ইত্যাদি দেখে রাজি হয়ে গেলাম যেতে। আরো ভেবেছিলাম শরীরে ট্যাটু দেখে কা'বা ঘরে আমাকে এমনিতেই ঢুকতে দেবে না। বাবা মা যখন ভেতরে থাকবে, আমি তখন চিল করবো। প্রথমে শর্ত দিয়েছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে গেলে যাবো। পরে আর হয় নি কারণ সে মুসলিম ছিল না। তাই, তাকে নিয়ে যাওয়া জটিল ব্যাপার।

শেষমেশ সেই প্রত্যাশিত দিনটা আসলো। সবার মুখে এক্সাইটমেন্ট দেখতে পারছিলাম। একমাত্র আমিই ছিলাম অনুভূতিহীন। তারপর, যথারীতি সৌদি পৌঁছলাম। আমার বোরকা আর স্কার্ফ পরিধান করতে হয়েছিল। জিম খিঁচে সহ্য করে গিয়েছি। কা'বা ঘর দেখতে যাওয়ার সময় চেকিং চলছিলো। আমি ইচ্ছে করে আমার হাতে ট্যাটু গুলো উন্মোচিত করে দিয়েছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে, তারা দেখেও কিছু বলল না। উল্টো আমায় ভাল কিছু হওয়ার আস্বাস দিলো। আমার রাগ বাড়লো, আর এই যায়গায় বেজে গিয়ে অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো।

ভেতরে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে এক যায়গায় থমকে গেলাম। আমার সামনে ছিল বিশাল এক কালো কাপড় দিয়ে ঘেরাও করা পাথর। টি.ভি. তে অনেক দেখেছি; তবে আজকে অন্যরকম লাগছে। পলকহীন ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলাম পাথরটার দিকে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম দু'চোখের কোণায় পানি জমে গেছে। তখন কি চিন্তা করছিলাম জানি না। দু' ফোটা চোখের পানি হাউ মাউ করে কান্নার দিকে মোড় নিলো। হাঁটু গেড়ে কাঁদতে লাগলাম। নতুন আগত লোকজন আমায় ঘেরাও করে রেখেছিল। অনেকের কাছে হয়তো এটা লজ্জাজনক। কিন্তু আমার মধ্যে এসবের ভয় নেই। আজীবন স্টেইজে হাজারো মানুষের সামনে পারফর্ম করে এসেছি আর এগুলো কি!

সেই মুহূর্তে জনপ্রিয়তার মূল অর্থ বুঝতে পেলাম। অনেক নামীদামী গায়গ গায়িকাদের শো তে গিয়েছিলাম। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছি। তবে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে এসঙ্গে এত তীব্র ভালবাসা ও সম্মান প্রদান করতে কোথাও দেখি নি। আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল। নিজের জীবনের প্রতি নিজের এত বেশি ঘৃণা হচ্ছিল যে ভেবেছিলাম আমেরিকা গিয়ে আত্মহত্যা করবো (পরে জানতে পেরেছিলাম এটি মহাপাপ)।

মক্কা মদিনার দিন গুলো যেন স্বপ্ন ছিল। বাবা-মা অনেক যায়গায় যেত, তবে আমি আমার মালিকের ঘরের সামনেই বসে থাকতাম। রাতে ঘুমাতেও ইচ্ছে করতো না! আমি ধর্মের বিধিবিধান সব মাসজিদুল হারামেই শিখি। যত শিখছিলাম, তত জ্ঞান অর্জনের পিপাসা বাড়ছিল।

বাড়ি ফিরে নিজের মধ্যে অকল্পনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারলাম। আগের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কটা তিতা লাগতে শুরু করলো। আমার রিলেশনশিপটা ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; তবে একবার ছেলেটাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার চেষ্টা করলাম এবং আল্লাহর কাছে দু'আ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার অন্তর বিগলিত হল। গত ৬ মাস আগে আমরা বিয়ে কেরেছি। আল্লাহর রহমতে আমরা দুজনই দ্বিন মেনে চলি। আমেরিকায় বসবাস করা জটিল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন হাজারো কল, হাজারো মেসেজ, হাজারো ডলারের অফার আসতো। এগুলো এভয়েড করতে করতে ক্লান্ত হয়ে, গতমাসে দেশে চলে আসি। বর্তমানে নিজেকে খুব নাজুক অবস্থানে দেখি। ভয় হয় আল্লাহ কে হারিয়ে ফেলার। ভয় হয় উনি যে পথ আমাকে দেখিয়েছেন, সেখান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার। ভয় হয় ভবিষ্যতের চিন্তা করলে। ভয় হয় অতীতের চিন্তা করলেও।
বর্তমানে আগের জীবনের সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। কুর'আনের একটি আয়াত যেন আমার পুরো জীবনের ঘটনাটি তুলে ধরে - "তিনি তোমাকে পথ হারা অবস্থায় পান, এবং তিনিই পথ দেখান"।

বলতে বলতে ম্যাম এক সময় কেঁদে দিলেন। হতভম্ভ হয়ে সবাই হত তালি দেওয়া শুরু করলো। পেছনে ঘুরে দেখলাম অনেকের চোখ-মুখ লাল।

ম্যাম কিন্তু সেদিনও আইডল ছিল। অতীতের ন্যায় তথাকথিত আইডল না; রবং আমাদের সকলের প্রকৃত আইডল। দ্বীন আল-ইসলামের রোল মডেল।








কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.