গল্পে গল্পে সংশোধন

গল্পে গল্পে সংশোধন


 [পর্ব-১]




মসজিদ থেকে একটু দূরেই চায়ের দোকান, সেখানে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম, চায়ের কাপে মাত্র চুমুক দিলাম, এর মধ্যে এক হুজুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো, সালাম দিলো, বিরক্তিকর কন্ঠে তার সালামের জবাব দিলাম, ওয়ালাইকুমুস সালাম।"
জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন? বললাম ভালো! আপনি? উত্তরে তিনি বললেন, জি আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি, হুজুর দেখলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়, কেন জানি তাঁদের দেখতেই ইচ্ছে করে না, আর কথা বলা তো একদমই না। কিছুক্ষণ চুপচাপ পাশেই বসে ছিলো, একটু পর ই আজান দিলো, সম্ভবত আজানের জবাব দিয়ে আমাকে বললো, চলুন ভাইজান আজান দিয়েছে নামাজে যাই, আমি বললাম, না ভাই আপনি যান, হুজুর লোকটি বললো, কি বলেন ভাই? আজান দিয়েছে আর একজন মুসলিম নামাজে যাবে না? এটা কি বিশ্বাস করার মতো?
কিছুটা বিব্রত হয়ে বললাম, আসলে ভাই আমার কাপড়ে সমস্যা, আপনি যান ইনশাআল্লাহ মাগরিবের নামাজে আসবো। লোকটি উত্তরে বললো, কাপড়ে সমস্যা মানে ভাইজান? আমি যতটুকু জানি কাপড়ে সমস্যা হয় মহিলাদের যখন তাঁরা ঋতুবর্তী হয়। আর আপনি তো একজন ছেলে, কিছুটা রাগী রাগী কন্ঠে বললাম, আরে ভাই কাপড়ে সমস্যা মানে প্রস্রাব লেগেছে, হুজুর লোকটি বললো, আরে ভাইজান এটা কোন সমস্যা ই না, আপনি সম্ভবত এই এলাকার মানুষ, আপনি কাপড় চেঞ্জ করে আসুন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।"
হুজুর লোকটিকে বললাম, আসলে ভাই আমার সব কাপড় ই এরকম, আমি আগামীকাল থেকে অবশ্যই আসবো ইনশাআল্লাহ, আজকে রাতেই সব কাপড় ধুয়ে দিবো, আপনি যান, নামাজ শুরু হয়ে যাবে। হুজুর লোকটি বললো, যেহেতু আপনার সব কাপড়ই এরকম তাহলে আপনার জন্য এই কাপড়েই নামাজ পড়া জায়েজ, আপনি এই কাপড়েই নামাজ আদায় করতে পারেন কোন অসুবিধা নেই, আর না হয় আরেকটি কাজ করতে পারেন, যদি আপনার প্রস্রাব ভিতরের ছোট প্যান্টে গেলে থাকে তাহলে ঐ প্যান্টি মসজিদের বাথরুমে খুলে আসতে পারেন, নামাজ পড়ে তারপর আবার পরে নিবেন। তা হলেই হলো, আর যদি তাও করতে আপনার সমস্যা হয় তাহলে এই কাপড়েই নামাজ পড়তে পারেন কোন অসুবিধা নেই ইনশাআল্লাহ।"
হুজুর দেখছি এমন হুজুর আর দেখি নাই, কোন উপায় না দেখে নামাজে যেতে বাধ্য হলাম, অযু করার জায়গায় পৌঁছে শয়তানী বুদ্ধি একটা আসলো, লোকটিকে বললাম, ভাই আমি তো অযুর দোয়া পারি না, আর অযুর দোয়া না পড়লে অযু হবে না, আর অযু না হলে নামাজ হবে না। সুতরাং আপনিই নামাজ পড়ে নিন, যেহেতু আমার অযুর দোয়া জানা নেই।"
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলো, আর বললো, আরে ভাইজান অযুর দোয়া তো আপনি জানেনই, আমি তো অবাক কি বলে এই ব্যাডা, বললাম, বলেন কি? অযুর দোয়া আমি পারি অথচ আমিই জানি না, হাস্যকর ব্যাপার! লোকটি বললো, আরে ভাইজান বিসমিল্লাহ তো বলতে পারেন? আমি বললা, হ্যাঁ পারি, লোকটি বললো, এটাই হলো অযুর দোয়া।"
"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ঐ ব্যক্তির নামায আদায় হয় না যে সঠিক ভাবে অযু করে না এবং ঐ ব্যক্তির অযু হয় না যে আল্লাহর নাম স্মরণ করে না (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ্ বলে না) [বুখারী ও মুসলিম] অযুর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত, ওয়াজিব বা ফরজ নয়, কেননা হাদীছে বলা হয়েছে: لاَ وَضُوْءَ অর্থাৎ- ওযু বিশুদ্ধ হবে না। ওযু পূর্ণ হবে না এরূপ অর্থ করা ঠিক নয়। এ ছাড়া অন্য কোন দোয়া সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।"
আর কোন পথ দেখছি না নামাজ পড়া ছাড়া, (মনে মনে বলছি) এক ওয়াক্ত ই তো পড়ে ফেলি কত গুনা করি একটু সওয়াবের কাজও তো করা দরকার।"
আর কোন অজুহাত না দেখিয়ে, অযু করে লোকটির সাথে মসজিদে ঢুকলাম, হুজুর লোকটি মসজিদের মুয়াজ্জিনকে জিজ্ঞেস করলো, নামাজের আর কতক্ষণ বাকি আছে? মুয়াজ্জিন বললো, আরো ১৫ মিনিট বাকি আছে।" এটা শোনে আরো বিরক্ত হলাম, যাক কি আর কারা বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া। বসতেই যাচ্ছিলাম, তখনই হুজুর লোকটি বললো, ভাইজান মসজিদে বসার পূর্বে দু রাকাত নামাজ পড়ে নিতে হয়, কেননা হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ মসজিদে আসে তখন সে যেন দু রাকাত নামাজ আদায় না করে না বসে [বুখারী] এ নামাজ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কেউ খুতবা চলাকালীন সময়েও মসজিদে আসে তখনও যেন দু রাকাত নামাজ পড়ে নেয়। [বুখারী]
ভাইজান আপনি নামাজ পড়ে নিন তারপর কিছু কথা বলবো আপনার সাথে যদি বিরক্ত না হন।"মনে মনে বলছি, আরে ভাই বিরক্ত তো সেই তখন থেকেই হচ্ছি আবার নতুন করে কি হবো?।
নামাজ শেষ করে, লোকটি আমার কাছে এসে বসলো, আর বললো, জানেন ভাইজান, জাহান্নাম সেই নাম যা থেকে যতটুকু সম্ভব আমরা দূরে থাকতে চাই, যে নাম শুনলে আমরা তা মস্তিষ্ক থেকে দূরে ঠেলে দিতে চাই, জাহান্নামী হওয়া তো দূরের কথা, আমরা এই নিয়ে চিন্তাও করতে চাইনা, কিন্তু জাহান্নাম সত্য, এবং আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা, এ ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন, আপনার সন্তান যদি আগুনের দিকে হাত বাড়ায়, আপনি কখনোই বলবেন না, তাকে আগুনের মতো ভয়াবহ বিষয়ের কথা বলে লাভ কি? ছোট মানুষ এসব কথা শুনলে ভয় পাবে, আপনি জানেন সে আগুনে হাত দিলে তার হাতটা পুড়ে যাবে, তাই আপনি তার প্রতি ভালোবাসার কারণেই তাকে আগুনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিবেন, আল্লাহ তা'আলাও সেটাই করেছে।
কুরআনুল কারীমে যেসব বিষয় বারবার এসেছে, তার মধ্যে একটি হলো জাহান্নামে ব্যাপারে সর্তকতা, কারণ আল্লাহ জানেন, মানুষ এ বিষয়ে অনেক খামখেয়ালী, আল্লাহর রহমত অসীম, এ কথা ভেবে অগণিত মানুষ জাহান্নামকে ভুলে, সে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিজেদেরকে ঠেলে দিবে। আল্লাহ জাহান্নাম কে সৃষ্টি করেছেন, অবিশ্বাসী, মুনাফেকদের জন্য, এবং এমন সব বিশ্বাসীদের জন্য, যারা অনেক বেশি গুনাহ করেছে, আর জাহান্নামের আছে এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধা।"
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা'আলা বলেন, একদিন জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার পেট কি ভরেছে? জাহান্নাম বলবে, আরো কিছু আছে কি? [৫০:৩০]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জাহান্নামের প্রান্ত থেকে, এর ভেতর একটি পাথর ফেলে দিলে সেই পাথর ৭০ বছর ধরে পড়তে থাকলেও, এর (জাহান্নামের) তলায় পৌছবে না।"
জাহান্নামের আছে অনেকগুলো স্তর, যে যত নিচের স্তরে থাকবে, তার শাস্তি তত বেশি হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তার চাচা আবু তালিব জাহান্নামবাসীদের মধ্যে, সবচেয়ে হালকা শাস্তি পাবে, এই হালকা শাস্তি হলো, তাকে আগুনের এক জোড়া জুতো পরিয়ে দেওয়া হবে, যার তাপের কারণে তার মস্তিস্ক ফুটতে থাকবে। [সহীহ মুসলিম]
জাহান্নামের সবচেয়ে নিম্ন স্তরে জায়গা হবে মুনাফিকদের, এবং তারা ভোগ করবে সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি গুলো, জাহান্নামের বাতাস হবে অত্যন্ত শুষ্ক, উত্তপ্ত, এবং জাহান্নামের পানি হবে, ফুটন্ত পানির মতো গরম, সেখানে ছায়া থাকবে শুধুমাত্র, একটি গভীর ধোঁয়া ভিতরে যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া দুষ্কর। জাহান্নামের আগুনের তাপ হবে, পৃথিবীর আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি, যেই পৃথিবীর আগুন এক মুহূর্তের জন্য, আমাদের শরীর সইতে পারে না, আমরা কি করে জাহান্নামের আগুন সহ্য করার কথা ভাবতে পারি?
জাহান্নামীদের উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, অতঃপর তোমরা আস্বাদ গ্রহণ করো, আমি তো তোমাদের আযাবই শুধু বৃদ্ধি করবো, [৭৮:৩০]
জাহান্নামের শাস্তি প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকবে, প্রতিদিন যে শাস্তি দেওয়া হবে, তা তার আগের দিনের চেয়ে বেশি হবে, অর্থাৎ এই শাস্তিতে কারো অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, একবার ভেবে দেখুন ভাইজান, এভাবেই জাহান্নামের জীবন চলতে থাকবে, ১০০ বছর নয়, ১০০০ হাজার বছর নয়, বরং অনন্তকালের জন্য থাকতে হবে সেখানে। কোটি কোটি বছর পার হয়ে যাবার পরেও, শাস্তির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলবে,।
-
আর জানেন ভাইজান, জাহান্নামে যাবার সর্বপ্রথম কারণ হিসেবে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, নামাজ না পড়া।"
-
লোকটির কথাগুলি শুনে অজান্তেই অশ্রু ঝরে পড়ছিল, যখন তিনি বললেন জাহান্নামে যাওয়ার সর্বপ্রথম কারণ হলো নামাজ না পড়া, আমি থমকে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল যে আমি এখনই জাহান্নামে প্রবেশ করবো, আমি যেন মালাকুল মাউতকে চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার জীবনের গুনাহ গুলি একের পর এক চোখে ভেসে উঠছিল, কত আজান শুনেছি কিন্তু মসজিদের দিকে দৌড়ে যাই নি, একটু আগেও তো রবের সামনে না দাঁড়ানোর জন্য কত অজুহাত দেখাচ্ছিলাম।রবের কত অবাধ্য হয়েছি, তারপরও তিনি আমাকে কোন আযাব দেন নি, বরঞ্চ একের পর এক নিয়ামত দিয়ে ভরে রেখেছেন, আর আমি কি-না সেই রবের অবাধ্যতা করছি।"
আর নয়, শয়তান আমাকে কত গাফেল করে রেখেছে, প্রতিনিয়ত সে আমাকে জাহান্নামের পথে ঠেলে দিচ্ছে, অন্তরে মোহর লেগে যাচ্ছে, এখনই সময় রবের কাছে ফিরে যাওয়ার, এখনই সময় তওবা করে সমস্ত গুনাহকে নেকিতে পরিবর্তন করে নেওয়ার।" নিশ্চয় আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল।"


[পর্ব-২]

ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি আসরের সময় হয়ে গিয়েছে, উঠে অজু করে দ্রুত মসজিদের দিকে অগ্রসর হলাম, যেয়ে দেখি জামাত শেষ, আর কাউকে না পেয়ে একা একাই সালাতে দাঁড়িয়ে গেলাম, আমি সালাত আদায় করতে করতে পুরো মসজিদ খালি, শুধু একজন ব্যক্তিই সেখানে বাকি ছিলো, সাধারণত আসরের নামাজ পড়ে লোকজন খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে।"
একা একাই সালাত শেষ করলাম, সালাত শেষ করে বসে বসে তাসবিহ গুনছিলাম, মসজিদে যেই একজন লোক বাকি ছিলো, সে আমার কাছে আসলো, সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন ভাইজান? আমি তার সালামের জবাব দিয়ে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনি? লোকটি বললো, আলহামদুলিল্লাহ, লোকটি আমার সামনে বসল, এবং বললো, ভাইজান কিছু কথা বলতাম যদি কিছু মনে না করেন তাহলে, আমি বললাম, আচ্ছা বলুন।"
লোকটি বললো, আপনাকে একটা হাদিস শুনাতে চাই, আমি বললাম, আচ্ছা শোনান, লোকটি বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মসজিদে বসেছিলেন, এমন সময় এক লোক মসজিদে সালাত আদায় করতে প্রবেশ করলো, এবং খুব দ্রুততার সাথে নামাজ আদায় করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মসজিদের এক কোণে বসে ছিলেন,নামাজ শেষ করে লোকটি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম কে সালাম দিলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যাও আবার সালাত আদায় কর। কেননা, তোমার সালাত হয়নি। সে লোকটি আবার সালাত আদায় করল এবং সালাম ফিরালো, তারপর আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি আবার সালাত আদায় কর কারণ, তোমার সালাত হয়নি। তিন বারের সময় লোকটি বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে আপনি সালাত শিখিয়ে দিন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটিকে বললেন, যখন সালাত পড়তে ইচ্ছা পোষণ কর, তখন প্রথমে ভালোভাবে ওযু কর এবং ক্বিবলার দিকে মুখ কর, কুরআনের যেখান থেকে সহজ হয় তিলাওয়াত কর, তারপর তুমি পরিপূর্ণ রুকু কর, রুকু হতে সোজা হয়ে দাঁড়াও, তার পর সেজদা কর, সেজদা হতে উঠে সম্পুর্ণ সোজা হয়ে বস, তারপর পরিপূর্ণভাবে সেজদা শেষ করে মাথা উঠাও এবং সোজা হয়ে দাঁড়াও, এভাবে তুমি তোমার সালাত সম্পন্ন কর। [বুখারী]
এই হাদীসটিতে লক্ষণীয় কিছু বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো, দ্রুততার সাথে সালাত আদায় না করা, উক্ত ব্যক্তিকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, শুধু এ কারণেই বলেছিলো, তোমার সালাত হয়নি, কারন সে খুব দ্রুততার সাথে সালাত আদায় করেছিল। তাহলে এ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যে দ্রুততার সাথে সালাত আদায় করলে তার সালাত হবেনা।"
লোকটির কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, এতদিন ধরে তো আমি এভাবেই সালাত আদায় করে আসছি, তাহলে কি আমার সালাত হয়নি? আর চুপ থাকতে পারলাম না, কান্না মিশ্রিত কন্ঠে লোকটিকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি আমার এতদিনের সব নামাজ শেষ?, লোকটি বলল, আরে ভাইজান ব্যাপারটি ওরকম না, আপনি তো আর জেনেবুঝে এমনটি করেননি, এটা আপনার অজান্তেই করে ফেলা একটি ভুল। আর যে ভুলবশত কিছু করে ফেলে, তারপর ভুল বুঝার পর নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাকে আল্লাহ শাস্তি দেন না এবং তার আমলও বিনষ্ট করেন না। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ আমার উম্মাতের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও ভুল ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তার সে কাজ যা সে করতে সে বাধ্য হয়েছে। [ইবনু মাজাহ ও বায়হাকী]
মনের ভয়টা এতক্ষণে দূর হলো, আমি লোকটাকে বললাম, অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া আপনাকে আমার এত বড় একটা ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। লোকটি বলল, আরে ভাইজান ধন্যবাদ এর কিছু নেই, দ্বীনের ব্যাপারে একে অপরকে সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য।"
লোকটি আরো বলল, জানেন ভাইজান, যখন আমরা নামাজে দাঁড়াই তখন কার সামনে দাঁড়াই? আমি বললাম আল্লাহর সামনে, লোকটি বলল, জ্বী ঠিক বলেছেন, কিন্তু আমাদের এই অনুভূতি কি নামাজে দাঁড়ালে থাকে?। মহান আল্লাহ যিনি সব কিছুর খালেক (সৃষ্টিকারী) তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন তার সামনে দাঁড়াতে(নামাজ পড়তে), আমরা যখন নামাজে দাঁড়াই তখন যেমন তেমন কারো সামনে দাঁড়াই না, আমরা দাঁড়াই মহান আল্লাহর সামনে, একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন তো, আপনি যখন কোনো দেশের প্রধান মন্ত্রীর সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন তখন আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে? নিজেকে কত সৌভাগ্যবান ই না মনে হবে।"
আর আল্লাহ্ তা'আলা তো একজন প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও অনেক উর্ধ্বে। জানেন ভাইজান? যখন একজন ব্যক্তি নামাজে দাঁড়ায় তখন তার মহান রব্ব (আল্লাহ) তার দিকে দৃষ্টি দেন, তার কথার উত্তর দেন, চিন্তা করুন তো ভাইজান, আপনার প্রিয় একজন শিল্পী বা খেলোয়াড় যদি আপনার সাথে সরাসরি কথা বলে, আপনার কথার রিপ্লাই করে তাহলে আপনার কেমন অনুভূতি হবে? কতটা প্রশান্তি লাভ করবে অন্তর।"
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার সামনে যখন আমরা দাঁড়াই তখনও কি আমাদের মধ্যে এরকম অনুভুতি থাকার কথা নয়?
আমি বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু সেই অনুভূতিটাই তো আসে না, আচ্ছা ভাই, আপনিই বলুনতো কিভাবে সেই অনুভূতি সৃষ্টি করা যায়? কিভাবে নামাজে গভীর মনোযোগ দেওয়া যায়? নামাজে দাঁড়ালে দুনিয়ার সব কিছুই মনে পড়ে যায়।
লোকটি বললো, নামাজে মনোযোগী হওয়ার জন্য প্রথম যে কাজটি আমাদের করতে হবে তাহলো ঢিলেঢালা ও উত্তম পোষাক পরিধান করা, কেননা নামাজে যদি আমরা টাইট-ফিট কাপড় পরিধান করি, তাহলে নামাজে মনোযোগী হওয়া বেশ কষ্টকর হবে, তাই সালাতের জন্য আমাদের উচিত, একটু ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা, এবং পোশাকের মধ্যে যেটি উত্তম সেটি গ্রহণ করা, এটি নামাজে মনোযোগী হতে বেশ সহায়ক, এ জন্যই তো আল্লাহতা'আলা বলেছেন, হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও,[৭:৩০]
দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, নামাজের পূর্বে চিন্তা-ভাবনা করা যে, আমরা কার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি, হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন কেউ নামাজে দাঁড়াবে, সে যেন এদিক সেদিক না তাকায়, কারন আল্লাহ তখন তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখেন যতক্ষণ না পর্যন্ত সে এদিক সেদিক তাকায় [তিরমিযি]।
চিন্তা করুন ভাইজান, আপনি যখন নামাজে দাঁড়ান তখন সে-ই মহান সত্তার সামনে দাঁড়ান, যিনি আপনাকে আমাকে আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং আমাদের পর যারা আসবে সবাইকে অস্তিত্ব দানকারী, যার রাজত্ব সবকিছুর উপর, নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবকিছুর রাজত্ব একমাত্র তার হাতে, সেরকম একজন সত্তার সামনে দাঁড়ালে আমাদের কেমন অনুভূতি থাকা উচিত?। সেটি আমরা আরো ক্লিয়ার হতে পারব আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে,যখন নামাজের সময় হত, তখন আলী রাদিআল্লাহু আনহু, কাঁপতে শুরু করতেন এবং তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যেত,যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, অসুবিধা কি?” তিনি উত্তরে বলেন, “এমন একটি আমানতের সময় শুরু হচ্ছে যে আমানতের ভার জান্নাত, পৃথিবী ও পাহাড়ের উপর অর্পণ করা হয়েছিল কিন্তু তারা তা বহন করতে নিজেদের দুর্বল মনে করেছিলো [ ৩৩:৭২] আর আমি এখন সেই আমানতের ভার নিতে যাচ্ছি।"
আল্লাহু আকবার, তাদের নামাজ, আমাদের চেয়ে ভিন্ন ছিল, কারণ নামাজে তাদের আবেগ-অনুভুতি ছিলো ভিন্নতর, আমাদেরও সেই আবেগ সেই অনুভূতি গুলো নিজেদের মধ্যে আনতে হবে ।"
তৃতীয় কাজ হচ্ছে, নামাজে আমরা কি পড়ি সেগুলি বুঝে বুঝে পড়া, যেমন আমরা সূরা ফাতিহা প্রতি রাকাতেই পড়ে থাকি, কিন্তু এর অর্থ বুঝিনা, আমরা সুরা ফাতিহার মাধ্যমে যে আল্লাহ তা'আলার সাথে কথা বলছি সে অনুভূতি আমাদের মধ্যে থাকে না। আল্লাহ্ তা'আলা হাদিসে কুদসিতে বলেছেন,
আমি সালাত (সুরা ফাতিহা) আমার ও আমার বান্দার মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিয়েছি, আর, আমার বান্দা যা চাইবে তাই তাকে দেওয়া হবে।
বান্দা যখন বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের জন্য, আল্লাহ তখন বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল।
যখন বান্দা বলে, আর রহমানির রহীম, পরম করুনাময় অতি দয়ালু, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণগান করল।
যখন বান্দা বলে, মালিকি ইয়াওমিদ্দীন, প্রতিফল দিবসের মালিক, তখন আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করল।
যখন বান্দা বলে, ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্ তা’ঈন, আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য চাই, তখন আল্লাহ তা'আলা বলেন, এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত এবং বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চাইবে।
অতঃপর যখন বান্দা বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম; সিরাতাল্লাযীনা আন’আমতা ‘আলাইহিম গইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ-দল্লীন, আমাদের সরল পথ দেখাও। তাদের পথ যাদের তুমি নিয়ামত দিয়েছ, তাদের পথ নয় যারা গজবপ্রাপ্ত এবং যারা পথভ্রষ্ট, তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, এ সব তো আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দা যা চাইবে তার জন্য তা-ই রয়েছে।[সহীহ মুসলিম]
চিন্তা করুন, কত সুন্দর একটি মুহূর্ত, এই মহাবিশ্বের মধ্যে এত ক্ষুদ্র একটা প্রাণী হয়ে আমরা আমাদের স্রষ্টার সাথে সরাসরি কথা বলছি, কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়া। কি চমৎকার সম্পর্ক,
চতুর্থ কাজ হচ্ছে, নামাজে করা প্রতিটি কাজকে যথার্থ উপলব্ধি করা, ক্বিরাত পড়ার সময়, এ অনুভূতি ও এ বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন, যে আমরা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলছি, তার কালাম আমরা পাঠ করছি।

পঞ্চম কাজ হচ্ছে, রুকু ও সিজদা যথার্থ উপলব্ধি করা, বিশেষ করে সেজদার সময়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বান্দা তার প্রভুর সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয় সেজদারত অবস্থায়। অতএব, তোমরা বেশি বেশি দোয়া কর।"[সহিহ মুসলিম]"
যখন আমরা সেজদায় থাকি, তখন আমরা আমাদের রবের সবচাইতে নিকটে চলে যাই, তখন থাকে না তার আর আমাদের মাঝে অন্য কেউ, তখনই তো সময়, নিজের সব চাওয়াকে রবের সামনে পেশ করার, সব অভিযোগগুলো তাকে খুলে বলার,
লোকটির কথাগুলো শুনতে বেশ ভালই লাগছিল, কিন্তু একটু ব্যস্ততার কারণে আর হলো না, আমি লোকটাকে বললাম, ভাই কিছু মনে করবেন না, আমার একটু জরুরী কাজ আছে, আমি যাই ইনশাআল্লাহ আবার কথা হবে, আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
--

এই ছোট্ট একটি লেখা পড়ে নামাজে পরিপূর্ণ মনোযোগী হওয়া সম্ভব নয়, চেষ্টা করুন নামাজে মনোযোগী হওয়ার ৩৩ টি উপায় বইটি কালেক্ট করতে, আরো ভালো হয় যদি ইমাম ইবনে কাইয়ুম (রাহঃ) এর খুশু-খুজু বইটি কালেক্ট করতে পারেন।"



[পর্ব-৩]


ময়মনসিংহ থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলাম, হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল, সামনে থেকে একজন লোক এসে বলল, গাড়িতে একটু সমস্যা হয়েছে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে ঠিক করতে আপনারা নেমে প্রয়োজন সেরে আবার গাড়ির কাছে চলে আসুন। দয়া করে এদিক সেদিক যাবেন না।"
গাড়ি থেকে নেমে দেখি একটু দূরেই মসজিদের মিনার দেখা যাচ্ছে, হোটেলে না ঢুকে চলে গেলাম মসজিদে, অজু করে মসজিদে ঢুকে দু'রাকাত নামাজ পড়ে, কোরআন তিলাওয়াত করছিলাম।
১০-১৫ মিনিট পর- এক ব্যক্তি এসে আযান দিলো, আযানের পর মুয়াজ্জিনকে জিজ্ঞেস করলাম, নামাজ কত মিনিট পর? উত্তরে বলল, ২০ মিনিট পরে। আমি আবার কোরআন তিলাওয়াত করতে লাগলাম। ২০ মিনিট পর ইমাম আসলো, ইকামত দেওয়ার পর ইমাম সাহেব বললেন, কাতার গুলো সোজা করুন, পায়ের সাথে পা কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান, কাতারের মাঝে কোন ফাঁক রাখবেন না, কাতার পূর্ণ করুন। আল্লাহু আকবার বলে তিনি নামাজ শুরু করলেন।"
নামাজের পর এক লোক দাঁড়িয়ে বলল, বাকি নামাজের পর আলোচনা হবে, আখিরাতের ফায়দার জন্য আলোচনায় যোগ দিতে পারেন।"
নামাজ পড়ে সব লোকজন বের হয়ে যাচ্ছিলো, ৪-৫ জনের মতো বাকি ছিল তার মধ্যে আমিও একজন, হুজুর বললেন, আজ আমরা আলোচনা করব কৃতজ্ঞতা নিয়ে, আমাদের ,অশান্তি, অস্থিরতা, হতাশার অন্যতম একটি কারণ হলো আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ থাকা। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, মানুষ ধ্বংস হোক! সে কত অকৃতজ্ঞ।[৮০:১৭] প্রিয় ভাইয়েরা! আমরাও সেই সব লোকদের মতো ধ্বংস হয়ে যাব যাদের আল্লাহ ধ্বংস হতে বলেছেন, যদি না আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হই।
আমরা কৃতজ্ঞ হলে আল্লাহর কোন ফায়দা নেই, ফায়দা তো হবে আমাদের, আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব।[১৪:৭] যদি আপনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হন, তাহলে তিনি আপনার সব কিছু বাড়িয়ে দিবেন, আপনার অর্থ-সম্পদ স্ত্রী-সন্তান। আপনার গাড়ি একটা আছে তিনি আপনাকে আরো একটা দিবেন, আপনার ফ্ল্যাট একটা আছে তিনি আপনাকে আরো একটা দিবেন। একবার কৃতজ্ঞ হয়ে তো দেখুন।"
অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির চাইতে কৃতজ্ঞ ব্যক্তি সবথেকে সুখী হয়, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই সুখী হতে পারে না! কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ছাড়া। কৃতজ্ঞতা একজন ব্যক্তিকে যেরকম পরকালীন কল্যাণ এনে দেয় তেমনি পার্থিব কল্যাণও বয়ে আনে। ২০০৩ সালে ২ হাজার ৬১৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপরে গবেষণা করে দেখাগেছে যারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা অমূলক ভয়-ভীতি অতিরিক্ত খাবার অভ্যাস এবং মদ, সিগারেট ও ড্রাগের প্রতিআসক্তির ঝুঁকি অনেক কম।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে মানুষকে নিয়মিত আরও বেশি কৃতজ্ঞ হতে অনুপ্রাণিত করলে, মানুষের নিজের সম্পর্কে যে হীনমন্যতা আছে নিজেকে ঘৃণা করা, নিজেকে সবসময় অসুন্দর, দুর্বল , উপেক্ষিত মনে করা, ইত্যাদিনানা ধরনের সমস্যা ৭৬% পর্যন্ত দূর করা যায়।
২০০৯ সালে ৪০১ জন মানুষের উপর গবেষণা করা হয়, যাদের ৪০% এর ক্লিনিকাল স্লিপ ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ জটিল ঘুমের সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে যারাসবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, তারা একনাগাড়ে বেশি ঘুমাতে পারেন, তাদের ঘুম নিয়মিত হয়, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং দিনের বেলা ক্লান্ত-অবসাদ কম থাকেন।
হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ড. জেফ্ররি ফ্রহ ১০৩৫ জন১৪-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন যারা বেশি কৃতজ্ঞতাদেখায়, তাদের পরীক্ষার ফলাফল অপেক্ষাকৃত ভালো, সামাজিকভাবে বেশি মেলামেশাকরে এবং হিংসা ও মানসিক অবসাদে কম ভোগে।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে কৃতজ্ঞ প্রাপ্তবয়স্কদের কাজের আগ্রহ শক্তি বেশি থাকে; তাদের সামাজিক সম্পর্ক বেশি হয় এবং যারাকৃতজ্ঞ নয় ওদের থেকে তারা বেশি সুখী। তারা অপেক্ষাকৃত কম হতাশা, হিংসা, লোভ বা অ্যালকোহলে আসক্ত হন। তারা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করেন, ভালোভাবে ঘুমান, নিয়মিত ব্যায়াম করেন, এমনকি ভাইরাসজনিত অসুখের প্রতি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে।"
সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, কত কল্যান এই কৃতজ্ঞতায়, অতএব আসুন প্রিয় ভাইয়েরা আমরা আমাদের রবের প্রতি কৃতজ্ঞ হই।"
হুজুর তার বক্তব্য শেষ করতেই যাচ্ছিলেন, এরমধ্যে এক ভাই প্রশ্ন করলো, হুজুর কৃতজ্ঞ হব বুঝলাম কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? মানে কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়ার উপায় কি?
হুজুর বললেন, একজন ব্যক্তিকে কৃতজ্ঞ হতে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা সাহায্য করে তা হল, নিজের চেয়ে নিম্ন স্তরের লোকদের দিকে লক্ষ্য করা। যেমনটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের চেয়ে কম সম্পদশালী মানুষদের প্রতি (পার্থিব ব্যাপারে) দৃষ্টি দিও, তোমাদের চেয়ে ধনশালী মানুষদের দিকে নয়। এতে করে তোমাদেরকে আল্লাহ তা'আলার দেয়া নি’আমাতসমূহ নগণ্য মনে হবে না।[তিরমিজি-২৫১৩]
আরো সহজ করে বলি, আপনার তো থাকার জন্য একটি বাড়ি আছে আপনি তাদের দিকে লক্ষ্য করুন যাদের সেটিও নেই, তাদের দিকে লক্ষ্য করবেন না যাদের দশতলা বিল্ডিং আছে। যদি আপনি দশতলা বিল্ডিং এর দিকে লক্ষ্য করেন তাহলে আপনি কখনো কৃতজ্ঞ হতে পারবেন না, আপনাকে লক্ষ্য করতে হবে যাদের তা নেই, যে আপনার চেয়ে নিম্নস্তরে আছে, তার দিকে লক্ষ্য করুন আর চিন্তা করুন আপনাকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তার চেয়েও কত ভালো রেখেছে।"
আপনার তো দুটি হাত আছে, এমন অনেক লোক আছে যাদের তা নেই, আপনার তো দুটি পা রয়েছে, কেমন কত লোক আছে যাদের তাও নেই, আপনার তো দুটি চোখ আছে, এমন হাজারো লোক আছে যাদের চোখ নেই, জুমার নামাজ পড়ে বের হতে দেখেন না? মসজিদের বাহিরে অন্ধ মানুষ গুলো কিভাবে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চায়, আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তো আপনাকে তার চেয়েও খারাপ অবস্থানে রাখেননি।"
আপনাকে আল্লাহ দুটি চোখ দিয়েছে এত সুন্দর পৃথিবী দেখার জন্য, ভাবুন তো আপনার কাছে যদি অটেল অর্থ-সম্পদ থাকতো, কিন্তু আপনার দুটি চোখই না থাকতো তাহলে কি আপনি সেই অর্থ-সম্পদ দেখে তৃপ্তি লাভ করতে পারতেন?।"
আপনিতো দিনে তিনবেলা ঠিকমত খেতে পারছেন, এমন হাজারো লোক আছে যারা সপ্তাহেও এক বেলা খেতে পায় না, রাস্তার ডাসবিন গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই দেখতে পাবেন এমন লোক এভেলেবেল। এমন কত লোক আছে যারা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, ভাবুন তো প্যারালাইজড হয়ে পড়ে থাকা ব্যক্তিটির জায়গায় যদি আপনি হতেন!
কিন্তু আপনি এখনো সুস্থ আছেন, চলাফেরা করছেন হাঁটছেন আনন্দ ফূর্তি করছেন। এসবের জন্য কি আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয়?।
যা পেয়েছেন তা নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকুন, যা পান নি সেটা নিয়ে আফসোস করবেন না, আপনার উপরের স্তরের লোকদের নয়‌। আপনার নিচের স্তরের লোকদের প্রতি লক্ষ্য করুন তবেই কৃতজ্ঞ হতে পারবেন।"
রাবী বিন আনাস [রহঃ] বলেছেন, নিশ্চয়ই যে আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন। যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি তার প্রতি নিয়ামত বৃদ্ধি করে দেন এবং যে তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি তাকে শাস্তি দেন’। এজন্যই পূর্বসূরীরা শোকরকে দু’টি নামে আখ্যায়িত করতেন। (১) আল-হাফিয (الْحَافِظُ) বা সংরক্ষণকারী। কেননা তা বিদ্যমান নিয়ামতগুলোকে হেফাযত করে। (২) আল-জালিব (الْجَالِبُ) বা আনয়নকারী। কেননা তা হারানো নিয়ামতকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসে। অতএব প্রতিটি নিয়ামতের বিনিময়ে আল্লাহর শোকর আদায় করতে ভুলবেন না। কেননা শোকর নিয়ামত টেনে আনে।"
তো ভাইয়েরা আমরা কৃতজ্ঞ হবো তো? সবাই বলল, ইনশাআল্লাহ হবো। হুজুর, বললেন, শুধু হবো বললেই হবে না সত্যি সত্যিই হতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা সবাইকে আমল করার তৌফিক দান করুক, আজকের মতো এখানেই, সবাই ভালো থাকবেন, আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।


[পর্ব-৪]


লোকটাকে প্রতি ওয়াক্তেই মসজিদে সবার আগে উপস্থিত হতে দেখি, আমার এমন কোন ফজর মনে পড়ছে না যে আমি মসজিদে উপস্থিত হয়ে লোকটাকে পাই নি। মসজিদে সবার আগে যেতেন সবার শেষে বের হতেন, যে কেউ দেখে তাঁকে খুব ধার্মিক ভাববে ,ঘন ঘন লম্বা দাড়ি ওয়ালা লোকটি।"

কোনো এক প্রয়োজনে একদিন লোকটার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ চোখে পড়লো, তিনি তার সঙ্গে এক মহিলাকে নিয়ে বের হচ্ছেন প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো দূর সম্পর্কিত কোনো আত্মীয় হবে কিছুক্ষণ কথা বলে জানতে পারলাম ঐ মহিলা দূর সম্পর্কিত কোনো আত্মীয় নয় বরং সে ঐ লোকের স্ত্রী। আমি থ হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম যে ব্যক্তিকে দেখি নি কখনো এক ওয়াক্ত সালাত ছেড়ে দিতে সেই ব্যক্তির স্ত্রী বে'পর্দা হয়ে তারই সাথে বাহিরে ঘুরতে যাচ্ছে? সব কিছু ই যেন ভূল ভূল মনে হচ্ছিল নিজেকে বিশ্বাস ই করাতে পারছিলাম না, যা দেখেছি তা সত্যিই ছিল।"

কিছুদিন পর লোকটার সাথে আবার দেখা হলো, ফজরের সালাত শেষে তার পাশে গিয়ে বসলাম সালাম দিয়ে অন্য কথা না বলে, বলতে শুরু করলাম হায় আফসোস আপনার জন্য, আপনি এতো আমল করেও জাহান্নামীদের তালিকায় নাম লিখাচ্ছেন। লোকটি রাগী রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি বলেছেন এসব?

আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই সত্যি ই বলছি, আচ্ছা আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন তারপর বিস্তারিত বলছি, আপনার স্ত্রী কি আপনার অবাধ্য?
লোকটি আরো রেগে গিয়ে বললো, মোটেও না সে আমাকে খুব ভালোবাসে আমার কোন কথাই অমান্য করে না।

উত্তরে বললাম, তাহলে শুনুন, কেন আমি আপনাকে বললাম এতো আমল করেও জাহান্নামীদের তালিকায় নাম লিখাচ্ছেন। এর কারণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: তিনি বলেছেন, তিন ব্যক্তির জন্যে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন- নেশাদার দ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তি, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, এবং দাইয়ুস। [মুসনাদে আহমাদ]

আপনি কি জানেন দাইয়ুস কে?: লোকটা মাথা নেড়ে বলল না, তাহলে শুনুন, দাইয়ুস সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“ঐ ব্যক্তিকে দাইয়ুস বলা হয় যে তার পরিবারের অশ্লীলতা ও কুকর্মকে মেনে নেয়।” (মুসনাদ আহমদ ও নাসাঈ)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-কন্যা সহ পরিবারের অধিনস্ত অন্য সদস্যদের বেপর্দা চলাফেরা ও অশ্লীল কাজকর্ম বা ব্যভিচারকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে অথবা কোনরূপ বাধা না দিয়ে মৌনতা অবলম্বন করে।

ইমাম যাহাবী (রহ:) এ সম্পর্কে আরো ক্লিয়ার করে বলেছেন, দাইয়ূস সে ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর ফাহেশা কাজ সম্পর্কে অবগত। কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসার কারণে এ ব্যাপারে সে উদাসীন থাকে। অথবা তার উপর তার স্ত্রীর বৃহৎ ঋণ বা মোহরানার ভয়ে কিংবা ছোট ছেলে-মেয়েদের কারণে সে স্ত্রীকে কিছুই বলে না এবং যার আত্ম-সম্মানবোধ বলতে কিছুই নেই’। [দেখুন যাহাবী, কিতাবুল কাবায়ের ১/৫০]"

এখানে মুল বিষয় হলো ফাহেশা তথা অশ্লীলতা। যে তার নিজ পরিবারে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে শিথিলতা প্রদর্শন করে স্ত্রী-কন্যাদেরকে পর্দার আদেশ করে না, পর্দা পালনে উৎসাহিতও করে না, ঘরে নিষিদ্ধ গান-বাদ্য দিব্যি চলে, এর কোন প্রতিবাদ করে না এ রকম সকল শরীয়াহ বিরোধী অশ্লীলতাকে মেনে নেয় – সে ব্যক্তি দাইয়ুস।"

আর কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়; [৬৬:৬]

দাইয়ুস ও তার পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর হাদিসের ভাষ্য তো স্পষ্ট।

আল্লাহ তা’আলা আদেশও করেছেন বান্দা যেন নিজেদেরকে এবং পরিবার-পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচায়। তাই সাধারণভাবে সমস্ত অধীনস্থদেরকে এবং বিশেষভাবে পরিবার-পরিজনদেরকে যাবতীয় বেহায়াপনা, অশ্লীলতা-অন্যায়-পাপাচার এবং বে-পর্দা চলাফেরা করা থেকে বিরত রাখা এবং তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো আমাদের উপর ওয়াজিব।"

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং নিজ নিজ অধীনস্থের বিষয়ে তোমাদের প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। অতঃপর দেশের শাসক জনগণের উপর দায়িত্বশীল। সে তার দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার পরিবারের উপর দায়িত্বশীল। অতএব, সে তার দায়িত্বশীলতার বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের উপর দায়িত্বশীলা। কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা হবে। দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল। সেও এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।” [বুখারী ও মুসলিম]

এখন নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন? অথবা আদৌ পালন করেছেন কি? বা এই দায়িত্বের অনুভূতিটুকুও কি আপনার মাঝে আছে? তাহলে কি আপনি দাইয়ুসদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছেন? আপনি কি প্রস্তুত? সেই জাহান্নামের জন্য যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর! [২:২৪]

লোকটি আর কিছুই বললো না শুধু আমার কথা গুলো শুনে গেলো।

চলবে...................


✍️---------- লেখা/Umar ibn Abdul kadir ❤️


কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.