রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনি (ধারাবাহিক পর্ব-৬)

স্নেহশীল পিতৃব্যের তত্ত্বাবধানে চেহারা মুবারক হতে রহমত বর্ষণের অন্বেষণ ফিজার যুদ্ধ
স্নেহশীল পিতৃব্যের তত্ত্বাবধানে
পিতার অন্তিম অসিয়তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আবূ ত্বালিব অত্যন্ত যত্নসহকারে ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভবিষ্যতের নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে লালন-পালন করতে থাকেন। আবূ ত্বালিব তাঁকে যে আপন সন্তানাদির অন্যতম হিসেবে লালন-পালন করতে থাকেন তা-ই নয়, বরং নিজ সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ-মমতা দিয়েই তাঁকে প্রতিপালন করতে থাকেন। অধিকন্তু, পিতা আব্দুল মুত্তালিবের মতই তিনিও তাঁকে নানাভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত এভাবে তিনি বিচক্ষণ চাচার অধীনে লালিত-পালিত হতে থাকেন। তাঁর চাচার সঙ্গে সংশ্লি­ষ্ট অন্যান্য ঘটনাবলী প্রসঙ্গক্রমে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হবে।
চেহারা মুবারক হতে রহমত বর্ষণের অন্বেষণ
ইবনে আসাকের, জালহুমাহ বিন ‘উরফুতাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি একবার মক্কায় আগমন করলাম। দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ তখন অত্যন্ত নাজেহাল এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত ছিলেন। কুরাইশগণ আবূ ত্বালিবকে বললেন, ‘হে আবূ ত্বালিব! আরববাসীগণ দুর্ভিক্ষজনিত চরম আকালের সম্মুখীন হয়েছেন। চলুন সকলে বৃষ্টির জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকটে দু‘আ করি’’। এ কথা শ্রবণের পর আবূ ত্বালিব এক বালককে (বালক নাবী (সাঃ))-কে সঙ্গে নিয়ে বাহির হলেন। ঐ বালককে আকাশে মেঘাচ্ছন্ন এমন এক সূর্য বলে মনে হচ্ছিল যা থেকে ঘন মেঘমালা যেন এখনই আলাদা হয়ে গেল। সেই বালকের আশপাশে আরও অন্যান্য বালকও ছিল, কিন্তু এ বালকটির মুখমন্ডল থেকে এ বৈশিষ্ট্য যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।
আবূ ত্বালিব সে বালককে হাত ধরে কাবা গৃহের নিকট নিয়ে গেলেন এবং ক্বাবা’হর দেয়ালের সঙ্গে তাঁর পিঠ লাগিয়ে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। বালক তাঁর চাচার হাতের আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সে সময় আকাশে এক টুকরো মেঘও ছিল না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এল এবং মুষল ধারে বৃষ্টিপাত শুরু হল। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এত বেশী হল যে উপত্যকায় প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে গেল এবং এর ফলে শহর ও মরু অঞ্চল পুনরায় সতেজ-সজীব হয়ে উঠল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবূ ত্বালিব মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যে প্রশংসা গীতি গেয়েছিলেন
তা হচ্ছে:
وأبيضَ يُستسقى الغَمَام بوجهه ** ثِمالُ اليتامى عِصْمَةٌ للأرامل
অর্থঃ ‘তিনি অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত। তাঁর চেহারা মুবারক দ্বারা রহমতের বৃষ্টি অন্বেষণ করা হয়ে থাকে। তিনি ইয়াতিমদের আশ্রয়স্থল এবং স্বামী হারাদের রক্ষক।’
(শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৫ ও ৬ পৃষ্ঠা।)
বাহীরা রাহেব
কথিত আছে যে, (এ বর্ণনা সূত্র কিছুটা সন্দেহযুক্ত) নাবী (সাঃ)-এর বয়স যখন বার বছর (ভিন্ন এক বর্ণনায় বার বছর দু’মাস দশদিন)
(একথা ইবনে জাওযী তালকিহুল ফোহুম ৭ পৃঃ।)
সেই সময়ে ব্যবসা উপলক্ষে চাচা আবূ ত্বালীবের সঙ্গে তিনি শাম দেশে (সিরিয়া) গমন করেন এবং সফরের এক পর্যায়ে বসরায় গিয়ে উপস্থিত হন। বসরা ছিল শাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি স্থান এবং হুরানের কেন্দ্রীয় শহর। সে সময় তা আরব উপদ্বীপের রোমীয়গণের আয়ত্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। এ শহরে জারজিস নামক একজন খ্রীষ্টান ধর্মযাজক (রাহেব) বসবাস করতেন। তাঁর উপাধি ছিল বাহীরা এবং এ উপাধিতেই তিনি সকলের নিকট পরিচিত এবং প্রসিদ্ধ ছিলেন। মক্কার ব্যবসায়ী দল যখন বসরায় শিবির স্থাপন করেন তখন রাহেব গীর্জা থেকে বেরিয়ে তাঁদের নিকট আগমন করেন এবং আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন। অথচ এর আগে কখনও তিনি এভাবে গীর্জা থেকে বেরিয়ে কোন বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি। তিনি কিশোর নাবী (সাঃ)-এর অবয়ব, আচরণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারেন যে, ইনিই হচ্ছেন বিশ্বমানবের মুক্তির দিশারি আখেরী নাবী (সাঃ)। তারপর কিশোর নাবী (সাঃ)-এর হাত ধরে তিনি বলেন যে, ‘ইনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের সরদার। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ব জাহানের রহমত রূপী রাসূল মনোনীত করবেন।’
আবূ ত্বালিব এবং কুরাইশের লোকজন বললেন, ‘আপনি কিভাবে অবগত হলেন যে, তিনিই হবে আখেরী নাবী?’ বাহীরা বললেন, ‘গিরি পথের ঐ প্রান্ত থেকে তোমাদের আগমন যখন ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হয়ে আসছিল আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, সেখানে এমন কোন বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখন্ড ছিল না যা তাঁকে সিজদা করে নি। এ সকল জিনিস নাবী-রাসূল ছাড়া সৃষ্টিরাজির অন্য কাউকেও কখনো সিজদা করে না। অধিকন্তু, ‘মোহরে নবুওয়াত’ দেখেও আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে কড়ি হাড্ডির পাশে সেব ফলের আকৃতি বিশিষ্ট একটি দাগ রয়েছে, সেটাই হচ্ছে ‘মোহরে নবুওয়াত’। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সূত্রে আমরা এ সব কিছু অবগত হতে পেরেছি।’ অতঃপর তিনি তাদেরকে আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন।
এরপর বাহীরা আবূ ত্বালিবকে বললেন, ‘এঁকে সঙ্গে নিয়ে আর বিদেশ ভ্রমণ করবেন না। শীঘ্রই একে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কারণ, এর পরিচয় অবগত হলে ইহুদী ও রুমীগণ এঁকে হত্যা করে ফেলতে পারে।
এ কথা জানার পর আবূ ত্বালিব তাঁকে কয়েকজন গোলামের সাথে মক্কা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
(মুখতাসারুস সীরাহ ১৬ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৮০-১৮৩ পৃঃ। তিরমিযী ও অন্যান্য বর্ণনায় উল্লে­খ রয়েছে যে বিলাল (রাঃ)-এর সাথে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ভুল। কেন না তখনো বিলালের জন্ম হয়নি। আর জন্ম হয়ে থাকলে আবূ তালিব আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন না। যাদুল মা’আদ ১/১৭।)
ফিজার যুদ্ধ
নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বয়স যখন বিশ বছর তখন ওকায বাজারে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের একপক্ষে ছিলেন কুরাইশগণ এবং তাঁদের মিত্র বনু কিনানাহ। বিপক্ষে ছিলেন ক্বায়স আয়লান। এ যুদ্ধ ‘ফিজার যুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত। কেননা বনু কিনানাহর বার্রায নামে এক ব্যক্তি ক্বায়স আয়লানের তিন লোককে হত্যা করে। এ খবর ওকাযে পৌছলে উভয় দলের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ বেধে যায়। কুরাইশ-কিনানা মিত্রপক্ষের সেনাপতি ছিলেন হারব বিন উমাইয়া। কারণ, প্রতিভা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে তিনি কুরাইশ ও কিনানাহ গোত্রের মধ্যে নিজেকে মান-মর্যাদার উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম দিকে কিনানাহদের উপর ক্বায়সদের সমর্থন ছিল বেশী, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে কিনানাহদেরই সমর্থন হয়ে যায় বেশী। অতঃপর কুরাইশের কতক ব্যক্তি উভয় পক্ষের নিহতদের বিষয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং বলেন যে, কোন পক্ষে বেশি নিহত থাকলে অতিরিক্ত নিহতের দিয়াত গৃহীত হবে। এতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়ে সন্ধি করে এবং যুদ্ধ পরিত্যাগ করে পরষ্পর শত্রুতা বিদ্বেষ ভুলে যায়। একে ফিজার যুদ্ধ এ জন্যই বলা হয় যে, এতে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ এবং পবিত্র মাসের পবিত্রতা উভয়ই বিনষ্ট করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিশোর বালক অবস্থায় এ যুদ্ধে গমন করেছিলেন। এ যুদ্ধে তিনি তীরের আঘাত থেকে তাঁর চাচাদের রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
(ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, কালবে জাযীরাতুল আরব ৩২০ পৃঃ এবং তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৩ পৃঃ।)
ইনশাহআল্লাহ! চলবে........

কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.