পথ হারানো মহিলার ঘটনা


পথ হারানো মহিলার ঘটনা

------------------------------------
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রাঃ) বলেন, আমি একবার হজ্জে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি রাস্তা অতিক্রম করার সময় দেখলাম একজন বৃদ্ধা বসে আছে। বৃদ্ধার পরিধানে একটি পশমের কামিজ এবং একটি ওড়না ছিল। আমি তার কাছে গিয়ে সালাম করলাম। বৃদ্ধা জাওয়াব স্বরূপ পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করলো ঃ

سلام؛ قولامن الرب الرحيم
"সালাম, দয়াবান রবের তরফ থেকে সম্ভাষণ। " (সুরা ইয়াসীন, ৫৮ আয়াত)

আমি বললাম, আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনি এখানে বসে কি করছেন?
তখন সে পাঠ করলোঃ
ومن يضلل الله فلا هادى له

" আল্লাহ যাকে পথহারা করেন তাকে পথ দেখাবার আর কেউ থাকেনা।" (সূরা আরাফ, ১৮৬ আয়াত)
আমি বুঝতে পারলাম মহিলাটি পথ হারিয়ে ফেলেছে তাই জিজ্ঞাসা করলাম, "কোথায় যেতে চান আপনি? ”

সে বললো-
سبحان الذى اسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام الى المسجد الاقصى
"তিনি একটি পবিত্র সত্ত্বা যিনি তার বান্দাকে রাত্রি বেলায় মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বসায় নিয়ে গিয়েছেন।" (সূরা ইসরা, ১ আয়াত)

বুঝতে পারলাম মহিলাটি হজ্জের কাজ শেষ করেছে - এখন সে বায়তুল মুক্বাদ্দাস যেতে চায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, কতক্ষণ এখানে বসে আছেন?

বৃদ্ধা বললো, ثلاث ليال سويا
"পূর্ণ তিনটি রাত ধরে।" (সূরা মারইয়াম, ৭৯ আয়াত)
আমি জিজ্ঞাসা করলাম - "আপনার কাছে আহারের কিছু দেখছিনা। কি খেয়ে কাটাচ্ছেন?
জাওয়াব দিলো, هو يطعمني ويسقين " তিনিই আমাকে খাইয়ে থাকেন এবং তিনিই আমাকে পান করিয়ে থাকেন।" (সূরা শুয়ারা, ৭৯ আয়াত)
জিজ্ঞাসা করলাম, "কিসের দ্বারা ওজু করে থাকেন?
বৃদ্ধা বললো, فيتممو صعيدا طيبا " পাক মাটি দিয়ে তখন তায়াম্মুম করে নিও।" (সূরা নিসা, ৪৩ আয়াত)
আমি বললাম, "আমার কাছে কিছু খাবার আছে, খাবেন?”
জাওয়াব দিলো, اتم الصيام الى الليل " রাত যখন হবে তখন ইফতার করিও।" (সূরা বাকারা, ৮৭ আয়াত)
আমি বললাম, "কিন্তু এটাতো রমজান মাস নয়।"
বৃদ্ধা বললো, ومن تطوع خيرا فان الله شاكر عليم
"যে ব্যক্তি সাওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে নফল ইবাদাত করে থাকে, আল্লাহ তার কদর করে থাকেন এবং তিনি সব জানেন।" (সূরা বাকারা, ১৫৮ আয়াত)
আমি বললাম, "মুসাফির অবস্থায় ফরজ রোজা না রাখাও তো জায়েয আছে।"
জাওয়াব দিলো, وان تصومواخيرالكم ان كنتم تعلمون
"(কত যে সাওয়াব) তোমরা যদি জানতে তাহলে রোজা রাখাটাই ভালো মনে করতে।"(সূরা বাকারা,১৮৪আয়াত)
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, " আপনি আমার মত করে কেন কথা বলেন না?”
জাওয়াব পেলাম, ما يلفظ من قول الالديه رقيب عتيد
"মানুষ যে কথাটিই বলছে খবরদারীর জন্য তার কাছে একজন ফেরেস্তা প্রস্তুত আছে।"(সূরা কা'ফ, ১৮আয়াত)
আবার জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি কোন গোত্রের লোক?”
সে বললো, ما تكف لك ليس له علم " যে বিষয়ে জানতে নেই, সে বিষয়ের পিছনে লাগিওনা। (সূরা ইসরা, ৩৬)
আরজ করলাম, "ভুল হয়ে গেছে, আমি মাফ চাইছি।"
মহিলা বললো, لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم
"আজ তোমাদের প্রতি কোন তিরস্কার নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে মাফ করে দিন।(সূরা ইউসুফ,৯২ আয়াত)
আমি বললাম, " যদি চান তবে আমার উটনীর পিঠে সাওয়ার হয়ে আপনার দলের লোকের কাছে যেতে পারেন।" বৃদ্ধা বললো, وما تفعلوا من خيريعلمه الله
" তোমরা যা কিছু ভালো কাজ করে থাকো, আল্লাহ তা জেনে থাকেন।" (সূরা বাকারা, ১৯৭ আয়াত)
এই আয়াত শোনার পর আমি আমার উঠনীকে বসালাম। কিন্তু মহিলা তার পিঠে সাওয়ার হওয়ার আগে বললো, قل للمؤمنين يغضوامن ابصارهم
"মুমিন ব্যক্তিদের বল তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচের দিকে করে রাখে। " (সূরা নূর, ৩০ আয়াত)
আমি আমার দৃষ্টিকে অবনত করে তাকে বললাম, "এবার সাওয়ার হোন।" বৃদ্ধা সাওয়ার হতে গেলো। কিন্তু উটনী ভয় পেয়ে পালাতে উদ্যত হলো। ধস্তাধস্তির ফলে বৃদ্ধার কাপড় ছিড়ে গেলো। তখন মহিলা তিলাওয়াত করলো, ما اصابكم من مصبيبةفبما كسبت ايديكم
"যত মুসিবত এসে থাকে তা তোমাদের আমলের কারণে। " (সূরা শুরা, ৩০ আয়াত)
আমি বললাম, "একটু অপেক্ষা করুন, উটনী বেধে দিচ্ছি তারপর সাওয়ার হবেন।" সে পাঠ করলো,
ففهمناهاسليمان"
"এই বিষয়ের মিমাংসা আমি সুলাইমান কে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।"(সূরা আম্বিয়া, ৭৯ আয়াত)
আমি উটনী ভালো করে বাধলাম। তারপর তাকে বললাম, " এবার সাওয়ার হোন।" সে সাওয়ার হয়ে এই আয়াত পড়লো,
سبحان الذى سخرلناهذا وما كنا له مقرنين واناالى ربنا لمنقلبون"পবিত্র সেই সত্ত্বা যিনি এইটাকে আমাদের আয়ত্বাধীন করে দিয়েছেন। আমাদের ক্ষমতা ছিলনা তাকে আয়ত্ব করার। আর আমরা আমাদের পরওয়াদেগারের নিকট নিঃসন্দেহে ফিরে যাবো।
(সূরা যুখরুফ, ১৪ আয়াত)
আমি উটনীর লাগাম ধরে হাটতে লাগলাম। খুব জোরে হাটছিলাম আর চিৎকার করে করে উটনী তাড়াচ্ছিলাম।
এই দেখে বৃদ্ধা বললো, واقصد في مشيك واغضض من صوتك "স্বাভাবিক পন্থায় হাটো আর তোমার স্বর অবনত কর।" (সূরা লুকমান, ১৯ আয়াত)
এবার আমি আস্তে আস্তে হাটতে লাগলাম আর কবিতার কয়েকটি ছন্দ গুনগুন করে গাইতে লাগলাম।
এই দেখে মহিলা পাঠ করলো, فاقرؤواما تيسر من القران
"কুরআন থেকে যে অংশ সহজ মনে হয়, তাই পড়।"
(সূরা মুযযাম্মিল,২০ আয়াত)
আমি বললাম, "আল্লাহ পাক সত্যি আপনাকে নেককার মহিলা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।" সে বললো,
ومايذكرالاالوالالباب"যাদের জ্ঞান আছে তারাই শুধু "
শিক্ষা গ্রহন করে থাকে।" ( সূরা আল-ইমরান,৭আয়াত)
কিছুক্ষণ চুপচাপ চলার পর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনার স্বামী আছে?”
মহিলা বললো, لاتسئلواعن اشياءان تبدلكم تسؤكم
" তোমরা এমন বিষয় জিজ্ঞাসা করিওনা,যা প্রকাশ করা হলে তোমাদের কাছে খারাপ লাগে।"
(সূরা মায়েদাহ, ১০১আয়াত)
এবার আমি চুপ হয়ে গেলাম। যতক্ষণ কাফেলা না পাওয়া গেলো, আমি তার সাথে কোন কথা বললাম না। কাফেলা যখন সামনে দেখতে পেলাম তখন তাকে বললাম, "এইযে সামনে কাফেলা এসে গেছে। এই কাফেলায় আপনার কে আছে?
সে পাঠ করলো, المال والبنون زينةالحياةالدنيا
" সম্পদ এবং পুত্র এসব দুনিয়ার জীবনের সোভা।"
(সূরা কাহাফ, ৪৬ আয়াত)
আমি বুঝতে পারলাম, এই কাফেলায় তার ছেলে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, "কি কাজ করে সে এই কাফেলায়?" বৃদ্ধা জাওয়াব দিলো,وعلمت وبنجم هم يهتدون "এবং পথ নির্নায়ক চিন্হসমূহ ও। আর নক্ষত্রের সাহায্যে তারা পথের নির্দেশ পায়।" (সূরা নাহল, ১৬)
বুঝতে পারলাম, তার ছেলে এই কাফেলার পথ নির্দেশক 'রাহবার'। মহিলাকে নিয়ে কাফেলার তাবুতে গেলাম। সেখানে বললাম, "বলুন এবার, এখানে আপনার কে আছে?" সে জাওয়াব দিলো,
واتخذالله ابراهيم خليلا
وكلم الله موسى تكليما
يايحيى خذالكتاب بقوة
"এবং আল্লাহ তায়া’লা ইব্রাহীম কে দোস্ত হিসেবে গ্রহণ করেছেন।" (সূরা নিসা, ১২৫ আয়াত)
" আর মূসা (আঃ) এর সাথে আল্লাহ পাক কথা বলেছেন।" (সূরা নিসা, ১৬৪ আয়াত)
"হে ইয়াহইয়া! সজোরে কিতাব গ্রহণ কর।"
(সূরা মারইয়াম, ১২ আয়াত)
এই আয়াতগুলো শোনার পর আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, "হে ইব্রাহীম! হে মূসা! হে ইয়াহইয়া!"
কিছুক্ষণ পর চাঁদের মত সুন্দর কয়েকজন নওজোয়ান আমার সামনে এসে দাড়ালো।
আমরা যখন স্থির হয়ে আসন গ্রহণ করলাম তখন মহিলা তার ছেলেদেরকে বললো -
فابعثوااحدكم بورقكم هذه الىالمدينة فلينظر ايهاازكى طعامافليأتكم برزق منه
"এই টাকা দিয়ে তোমাদের মধ্য হতে কাউকে শহরে পাঠাও। সে অনুসন্ধান করে দেখবে কোন খাবারটি অধিক পবিত্র। তখন সে তোমাদের জন্যে সেখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসবে।" (সূরা কাহাফ, ১৯ আয়াত)
এই আয়াত শুনে তাদের মধ্য হতে একটি ছেলে উঠে গেলো এবং কিছুক্ষণ পরে খাবার নিয়ে আসলো। খাবার আমার সামনে যখন রাখা হলো, তখন মহিলাটি বললো, كلواوشربواهنينابمااسلفتم فى الايام
"সানন্দে খাও এবং পান কর, এগুলো তোমাদের সেই কাজের বিনিময়ে, যে কাজ তোমরা পূর্বে করে এসেছো।" (সূরা আল-হাক্ক্বাহ,২৪ আয়াত)

আমি আর থাকতে পারলাম না। ছেলেদের কে বললাম, "এই খাবার আমার জন্যে হালাল হবেনা যতক্ষণ না তোমরা এই মহিলার রহস্য বলছো।"
ছেলেরা আমাকে বলল, ৪০ বছর থেকে আমাদের মায়ের এই অবস্থা। এই ৪০ বছরে তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াত ছাড়া একটি বাক্যও বলেন নি। এই জন্যে এই নিয়ম তিনি পালন করছেন যেন জিহবা থেকে কোন অপ্রয়োজনীয় কথা বাহির না হয়ে পড়ে। তাহলে আল্লাহ নারাজ হবেন।
আমি বললাম, ذالك فضل الله يؤتيه من يشاء والله ذو الفضل العظيم
" এসব আল্লাহ পাকের অনুগ্রহের নিয়ামত। যাকে ইচ্ছে প্রদান করেন। আর আল্লাহ তায়া’লা
অনুগ্রহশীল মহান।" (সূরা হাদীদ, ২১ আয়াত)




কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.