রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনি (ধারাবাহিক পর্ব-১৬)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনি (ধারাবাহিক পর্ব-১৬)
◾হজ্জ যাত্রীগণকে বাধা দেয়ার বৈঠক
যে সময়ের কথা ইতোপূর্বে বলা হল সেই সময়ে কুরাইশগণের সামনে আরও একটি সমস্যা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রকাশ্য প্রচার অভিযানের কয়েক মাস অতিবাহিত হতে না হতেই হজ্জের মৌসুম এসে উপস্থিত হল। যেহেতু এ মৌসুমে আরব ভূমির দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দলের আগমন আরম্ভ হয়ে যাবে এবং সেহেতু মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁদের নিকটে প্রচারাভিযান শুরু করবেন সেহেতু তাঁর সম্পর্কে সমাগত সকলের নিকট এমন এক কথা বলার প্রয়োজনবোধ করলেন যার ফলে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর ক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না। এ প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সলাপরামর্শের জন্য তাঁরা অলীদ বিন মুগীরার গৃহে সমবেত হলেন।
অলীদ বললেন ‘এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত ঠিক, কারো যাতে এ নিয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ কিংবা মত পার্থক্যের সৃষ্টি না হয় এবং তোমাদের একজনের কথাকে অন্যজন যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে।’
অলীদ বললেন ‘এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত ঠিক, কারো যাতে এ নিয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ কিংবা মত পার্থক্যের সৃষ্টি না হয় এবং তোমাদের একজনের কথাকে অন্যজন যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে।’
অন্যেরা বললেন, ‘আপনি একটা মোক্ষম মন্তব্য ঠিক করে দিন তাহলেই তা আমাদের সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।’
তিনি বললেন, ‘না তা হবে না বরং তোমরা বলবে এবং আমি তা শুনব।’
ওলীদের এ কথার পর কয়েকজন সমস্বরে উঠলেন ‘আমরা মন্তব্য করব যে, তিনি কাহিন।’
অলীদ বললেন, ‘না আল্লাহর শপথ তিনি কাহিন (গণক) নয়।
আমরা অনেক কাহিন দেখেছি। ইনি তো কাহিনদের মতো গুনগুন করে গান গান না। ছন্দাকারে কবিতা আবৃত্তি করেন না কিংবা কবিতা রচনাও করেন না।’
অন্যরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে একজন পাগল বলব।’
অলীদ বললেন, ‘না তিনি তো পাগল নন, আমরা পাগল দেখেছি এবং তাঁর রকম সকম সম্পর্কে জানি। এ লোকের মধ্যে পাগলাদের মতো দম বন্ধ করে থাকা, অস্বাভাবিক কোন কাজকর্ম করা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা কিংবা অনুরূপ কোন কিছুই তো দেখি না।’
অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।’
অলীদ বললেন, ‘তাঁর মধ্যে কবির কোন বৈশিষ্ট্য নেই যে, তাঁকে কবি বলা হবে। রযয, হাজয, কারীয, মাকবুয, মাবসুত ইত্যাদি সর্বপ্রকার কাব্যরীতি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যাহোক তাঁর কথাবার্তাকে কিছুতেই কাব্য বলা যেতে পারে না।’
অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে যাদুকর বলব।’
অলীদ বললেন, ‘এ ব্যক্তিকে যাদুকরও বলা যেতে পারে না। আমরা যাদুকর এবং যাদু সংক্রান্ত নানা ফন্দি-ফিকির দেখেছি, তারা সত্যমিথ্যা কত কথা বলে, কত অঙ্গ-ভঙ্গি করে কত যে, ঝাড়-ফুঁক করে এবং গিরা দেয় তার ইয়ত্তা থাকেনা। কিন্তু এ ব্যক্তি তো যাদুকরদের মতো সত্য-মিথ্যা কথা বলা, ঝাড়-ফুঁক কিংবা গিরা দেয়া কোন কিছুই করে না।’
অন্যেরা তখন বললেন, ‘আমরা তাহলে আর কী বলব।’
অলীদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, তাঁর কথাবার্তা বড়ই মিষ্টি মধুর, তাঁর ভিত শিকড় বড়ই শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা বড়ই মনোমুগ্ধকর। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যাই বল না কেন, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে কিছুক্ষণ থাকবেন তাঁরা তোমাদের কথাবার্তাকে অবশ্যই মিথ্যা মনে করবেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পুনরায় তিনি বললেন, ‘তাঁর সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে খুব জোর যাদুকর বলতে পারো। তাঁর এটা কিছুটা উপযোগী বলে মনে হতে পারে। তিনি এমন সব কথা উত্থাপন করেছেন যা যাদু বলেই মনে হয়। তিনি পিতাপুত্রের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে গোত্রে গোত্রে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁকে যাদুকর বলার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
ফুটনোটঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।
কোন কোন বর্ণানায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, অলীদ যখন তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন তখন তাঁরা বললেন, ‘আপনি তাহলে আপনার গ্রহণযোগ্য অভিমত ব্যক্ত করুন।’ প্রত্যুত্তরে অলীদ বললেন, ‘আমাকে তবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দাও।’ এরপর তিনি বহুক্ষণ ধরে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং উল্লেখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।
ফুটনোটঃ ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৮৮।
এ ব্যাপারে অলীদ সম্পর্কে সূরাহ মুদ্দাসসিরের ১৬ টি আয়াত (১১-২৬) অবতীর্ণ হয়েছে :
{ذَرْنِيْ وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيْدًا وَجَعَلْتُ لَهُ مَالًا مَّمْدُوْدًا وَبَنِيْنَ شُهُوْدًا وَمَهَّدتُّ لَهُ تَمْهِيْدًا ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيْدَ كَلَّا إِنَّهُ كَانَ لِآيَاتِنَا عَنِيْدًا سَأُرْهِقُهُ صَعُوْدًا إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَقَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَفَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِسَأُصْلِيْهِ سَقَرَ}
‘১১. ছেড়ে দাও আমাকে (তার সঙ্গে বুঝাপড়া করার জন্য) যাকে আমি এককভাবে সৃষ্টি করেছি।
১২. আর তাকে (ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্কে) দিয়েছি অঢেল ধন-সম্পদ,
১৩. আর অনেক ছেলে যারা সব সময় তার কাছেই থাকে।
১৪. এবং তার জীবনকে করেছি সচ্ছল ও সুগম।
১৫. এর পরও সে লোভ করে যে, আমি তাকে আরো দেই।
১৬. কক্ষনো না, সে ছিল আমার নিদর্শনের বিরুদ্ধাচারী।
১৭. শীঘ্রই আমি তাকে উঠাব শাস্তির পাহাড়ে (অর্থাৎ তাকে দিব বিপদের উপর বিপদ)।
১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল,
১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল!
২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো।
২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো।
২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে।
২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’
২৬. শীঘ্রই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব।’
(আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১১-২৬)
১২. আর তাকে (ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্কে) দিয়েছি অঢেল ধন-সম্পদ,
১৩. আর অনেক ছেলে যারা সব সময় তার কাছেই থাকে।
১৪. এবং তার জীবনকে করেছি সচ্ছল ও সুগম।
১৫. এর পরও সে লোভ করে যে, আমি তাকে আরো দেই।
১৬. কক্ষনো না, সে ছিল আমার নিদর্শনের বিরুদ্ধাচারী।
১৭. শীঘ্রই আমি তাকে উঠাব শাস্তির পাহাড়ে (অর্থাৎ তাকে দিব বিপদের উপর বিপদ)।
১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল,
১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল!
২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো।
২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো।
২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে।
২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’
২৬. শীঘ্রই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব।’
(আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১১-২৬)
যার মধ্যে কয়েকটি আয়াতে তাঁর চিন্তার ধরণ সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
{إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ فَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ}
‘‘১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল,
১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল!
২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো।
২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো।
২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে।
২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’
(আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১৮-২৬)
১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল!
২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো।
২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো।
২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে।
২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’
(আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১৮-২৬)
যা হোক, তাঁরা যে সিদ্ধান্ত করলেন তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন। কিছু সংখ্যক কাফির মক্কায় আগমনকারী হজ্জযাত্রীগণের পথের পাশে কিংবা পথের মোড়ে মোড়ে জটলা করে নাবী কারীম (সাঃ)-এর প্রচার এবং তাবলীগের ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই বলে হজ্জযাত্রীগণকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করলেন। নাবী কারীম (সাঃ) সম্পর্কে তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে তাঁর সম্পর্কে বহু কিছু বলতে থাকলেন।
ফুটনোটঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।
এ সব ব্যাপারে আবূ লাহাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
হজ্বের মৌসুমে হজ্ব যাত্রীগণের শিবিরে এবং উকায, মাজিন্নাহ ও যুলমাজায বাজারে নাবী কারীম (সাঃ) যখন আল্লাহর একত্ব এবং দ্বীনের তাবলীগ করতেন তখন আবূ লাহাব তাঁর পিছন পিছন গিয়ে বলতেন, ‘এর কথায় তোমরা কান দিয়ো না। সে মিথ্যুক এবং বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে।
ফুটনোটঃ তিরমিযী মসনাদে আহমাদ ৩য় খন্ড ৪৯২ পৃঃ ও ৪র্থ ৩৪১ পৃঃ।
এভাবে দৌড় ঝাপের ফল হল যে, হজ্ব পালনের পর হাজীগণ যখন নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে ভালভাবে অবগত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাছাড়া তাঁরা এ কথাও অবগত হয়ে গেলেন যে মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়ত দাবী করেছেন। এভাবে হজ্ব যাত্রীগণের মাধ্যমেই নাবী কারীম (সাঃ)-এর নবুওয়ত এবং ইসলামের প্রাথমিক কথাবার্তা সমগ্র আরব জাহানে বিস্তার লাভ করল।
ইনশাহ আল্লাহ! চলবে........
কোন মন্তব্য নেই
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু