(জীবন - মৃত্যু -জীবন) পর্ব-১ ,,,, মৃত্যু ‌‌|

(জীবন - মৃত্যু -জীবন)
 পর্ব-১ ,,,, মৃত্যু ‌‌|

জীবনের যে বাস্ববতার ব্যাপারে বিশ্বাসী - অবিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ নিশ্চিত তা হচ্ছে "মৃত্যু"। আমরা জীবন যাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি, দ্বায়িত্ব পালনের জন্য ছুটে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে।
দিন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে চোখ দুটো বন্ধ করে চলে যায় ঘুমের জগতে। আমরা কি চোখ দুটো খুলতে পারবো? যে ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের সব চিন্তা - দুর চিন্তা সেই ভবিষ্যত কি আমাদের কাছে ধরা দিবে?
একদিন পরিবারের কোনো সদস্য বা খুব কাছের কোনো মানুষ চোখ বন্ধ করে দিল আর খুলতে পারলো না। আপনি হতভম্ব হয়ে গেলেন যে বিশ্বাসই হচ্ছে না সেই মানুষটা সত্যি সত্যি চিরতরে আপনার কাছ থেকে চলে গেছে।
অন্তরটা যেন অবশ হয়ে গিয়েছে, মরা দেহটাকে গোসল করানো হলো, দাফন করা হলো। যে মানুষ টিকে নাম ধরে ডাকতেন ; মা বলতেন বাবা বলতেন কতো আদরের নাম ধরে ডাকতেন। সেই মানুষ টাকে আজ সবাই লাশ বলে সম্বন্ধন করছে।
লাশ কাঁধে নিয়ে আপনি হাটা দিলেন কবর স্হানের পানে, কবর খোরা হয়ে গিয়েছে ; লাশ নামানোর জন্য কজন মিলে কবরে নেমে পড়লেন। বুকটা ধরপর করে উঠে, চারিদিকের মাটি যেন চেপে ধরেছে। বাকিদের দেখে কিছুটা সাহস পেলেন। লাশ কবরে নামিয়ে নিলেন৷
এবার আপন সেই মানুষটিকে সেই অন্ধকার গর্তে রেখে আপনার উঠে আসার পালা। নিজ হাতে মাটি নিয়ে সেই মানুষটির উপর ফেললেন। সাদা কাফনে মাটি পরতে থাকে, পরতে থাকে। দেখতে দেখতে কবর ভরপুর হয়ে যায়।
কারো কারো চোখে জল, আপনি সেখানে দাড়িয়ে আছেন। আপনার মুখ শুকিয়ে গেছে। সেই কবরের দিকে তাকিয়ে আপনি যেন নতুন করে উপলব্ধি করলেন, যে মানুষ টা আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে আপনি তারই পেছন পেছন ছুটছেন। তিনি যে জগতে প্রবেশ করেছে আপনি না চাইলেও শীঘ্রই সেই জগতেই প্রবেশ করবেন৷
কেমন হবে সেই দিনটি? মৃত্যু বরন করার অভিজ্ঞতাটা আসলে কেমন?
আল্লাহর অশেষ রহমত, নিশ্চিত এই গন্তব্যের চিত্রটি তিনি তার রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যেন আমরা সেই দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
বছর খানেক পার হয়ে গেল আপনি শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। আপনার শ্বাস দূর্বল হয়ে আচ্ছে। আপনার মনে পরছে ছোটবেলার নানান স্মৃতি, মনে পরছে অর্জন গুলো, মনে পরছে ভুলগুলো আর অনেক বেশী আপসোস হচ্ছে যে সময়গুলি অপচয় করেছিলেন তার জন্য!
যতটুকু সময় বাকি আছে তা অপচয় করা যাবে না। নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে আপনি উচ্চারণ করলেন, "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ " অন্তরে আপনি জিকির করতে থাকলেন। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আচ্ছে, সামনে দাড়িয়ে থাকা কাছের মানুষগুলো ছোটাছুটি করছে। কিন্তু আপনি তাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। বরং চোখের কোনে এক অদ্ভুত আলো ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে লাগল। কি সুন্দর সেই আলো!!! মনোরম, চোখ জুরিয়ে যাচ্ছে! এই আলো ওরা আগে জ্বালিয়ে দিলো না কেন! ধীরে ধীরে আপনার নাকে ভেসে আসলো এক নতুন ঘ্রান।
এটা কি কোনো ফুলের ঘ্রান, নাকি কোনো সুগন্ধি? এক অদ্ভুত ভালো লাগা আপনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে আর আপনার সব শারীরিক কষ্ট দূর হয়ে যাচ্ছে। এরপর আপনাকে পুরোপুরি চমকে দিয়ে একদল মানুষ আপনার দিকে ভেসে আসে!
কিন্তু কৈ ওরা তো মানুষ নাহ্, তাদের মুখগুলো এত উজ্জ্বল যেন সূর্য কেও হার মানায়। আপনার মনে পরে গেল রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদিস এবং আপনি বুঝতে পারলেন এরাই হচ্ছে সেই ফেরেশতাদের দল যারা আপনাকে আপনার নতুন দুনিয়াতে স্বাগত জানাতে এসেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন পুরো ঘরটা ফেরেশতাদের নূর দিয়ে ভরে গেল। আপনি যেদিকেই তাকাচ্ছেন যেন অগনিত ফেরেশতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। এরপর একজন ফেরেশতা আপনার একদম কাছে এগিয়ে আসে। আপনি বুঝতে পারেন তিনিই হচ্ছেন মালা কুল মওত মৃত্যুর ফেরেশতা।
তিনি আপনার মাথার কাছে এসে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে বলেন, "হে পবিত্র আত্মা? আল্লাহর ক্ষমার জগতে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জগতে বেরিয়ে আসো।" আপনি যেন এই আহবানের ই অপেক্ষা করছিলেন জন্ম থেকে।
আপনি এত সহজে, এত দ্রুত দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন যেন এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে পানি ঢালা হলো এবং ফেরেশতাদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হলো আপনার সন্তান জন্ম হওয়ার সময়টির কথা যখন শিশুটি জন্ম নিয়েছিল, প্রতিটি মানুষের মুখে ছিল উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা। সবাই তাকে কোলে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। আজ আপনি যখন আপনার দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন সব ফেরেশতারা যেন সেরকমই উচ্ছ্বাসিত। আপনাকে কোলে নেওয়ার জন্য তারা প্রতিযোগীতা করতে লাগল।
তারা আপনাকে এক স্বর্গীয় কাপড়ে আবরন দিয়ে, অপূর্ব সুন্দর সুগন্ধি লাগিয়ে আপনাকে নিয়ে চললো আসমানের দিকে। আপনি যেন আলোর বেগে আকাশ পাড়ি দিতে লাগলেন, আপনাকে ঘিরে রয়েছে অগনিত ফেরেশতা। আকাশ দিয়ে ভ্রমন করতে করতে আপনি বিভিন্ন ফেরেশতাদের দল পার হতে লাগলেন৷
প্রতিটি ফেরেশতাদের দল আপনার পরিচয় জানতে চাইল। আর আপনার আশে পাশে থাকা ফেরেশতারা আপনার নাম বললো এবং সেই সাথে আপনাকে পৃথিবীতে যত ভালো ভালো নামে ডাকা হয়েছিল সেই নামে তারা বাকিদেরকে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল।
আপনি এমন সব দৃশ্য, এমন সব সৃষ্টি দেখতে লাগলেন যে আল্লাহর প্রশংসা ছাড়া কোনো কথাই আপনার মুখে আচ্ছিল না। এ জগত এতো প্রকান্ড, এতো বিচিত্র ! পৃথিবীতে থাকতে যেটাকে আপনি আধুনিক প্রযুক্তি ভেবেছিলেন , সেই আধুনিক প্রযুক্তি তো এ জগতের অনু পরিমাণ বাস্তবতাও তুলে ধরতে পারে নি। ভাষা হারিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আপনি সব দেখতে লাগলেন এবং অবশেষে আপনাকে নিয়ে ফেরেশতারা পোঁছে যায় সপ্তম আসমানের দ্বার প্রান্তে।
এরপর আপনার অন্তর যেন কেপে উঠল কারন আপনি সারা জীবন যে সত্তার কাছে আপনার মনের সব আকাঙ্ক্ষা গুলো বলে এসেছিলেন, যে সত্তা তার অসীম রহমত আর ভালোবাসার মাধ্যমে আপনার সাথে কথা বলেছিল। আজ সেই মহান রব্বুল আ'লামিনের কন্ঠ আপনি সরাসরি শুনতে পেলেন এবং তিনি আপনার প্রশংসা করে অসীম মমতা ভরা কন্ঠে বললেন, " আমার আবদের বই ইল্লীইনে উঠিয়ে রাখো আর তাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নাও, আমি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে মাটিতেই ফিরিয়ে দিচ্ছি এবং একদিন আবারও তাকে মাটি থেকেই বের করে আনবো।"
আল্লাহর কন্ঠ শুনে আপনার মতো পাপী বান্দার, তার যে দয়া এবং ভালোবাসা সুস্পষ্ট প্রকাশ পেল, তার শুনে আপনার পুরো সত্তা যেন অপার উল্লাসে আলোকিত হয়ে উঠলো।
ফেরেশতারা আপনাকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিতে লাগল। কিন্তু আপনি যেন আপনার রবের সেই মায়া ভরা কন্ঠ ছাড়া আর কিছু নিয়েই ভাবতে পারছেন না। অবশেষে আপনি ফিরে এলেন দুনিয়াতে, ততক্ষণে আপনার মর দেহ কবরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।
আপনাকে সেই কবরেই ফিরিয়ে দেওয়া হলো আনন্দময় যাত্রা শেষে। এবার কবরের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। ভাবতে লাগলেন আপনি কতটা সৌভাগ্যবান, আপনার রব কতটা দয়াশীল যার রহমত ছাড়া এমন আনন্দের অভিজ্ঞতা কখনোই সম্ভব হতো না৷
আপনার মনে পড়ে গেল আপনার হাবীব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদিসটি এবং আপনার মনে পড়ে গেল আজ আপনি ঈমান নিয়ে মৃত্যু বরন না করলে আপনার পরিনতি কেমন হতো!
অবিশ্বাসী হয়ে মৃত্যু বরণ করলে আপনার কাছে মালা কুল মওত এবং তার সাথীরা আসত ভয়ংকর রূপ নিয়ে। তাদের দেখামাত্র আপনি তাদের থেকে দূরে পালিয়ে যেতে চাইতেন৷ কিন্তু পালানোর কোনো সুযোগ তখন থাকত না৷
মা'লা কুল মওত এগিয়ে আসত আপনার কাছে এবং ঘৃনা ভরা কন্ঠে বলতো, " বের হয়ে আই হে অশুভ আত্মা, এই অশুভ শরীর থেকে বের হয়ে আই, তোর জন্য শাস্তি অপেক্ষা করছে । " এবং সে এমন ভয়ানক কথা বলত আপনার শাস্তির কথা না বললেও সেই আত্মা বের হতো না।
আপনার মৃত প্রায় শরীরকে আকড়ে ধরে রাখত এবং তখন মা'লা কুল মওত এমনভাবে আপনার আত্মা টাকে টেনে হিসড়ে আপনার শরীর থেকে বের করে আনতো, যেমনটা ঘন কাটা যুক্ত ডালের মধ্য থেকে তুলো বের করে আনা হয় এবং আপনার আত্মা বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বাকি ফেরেশতারাও আপনাকে ধিক্কার জানাতে থাকতো৷
আপনাকে নিয়ে আসমান পাড়ি দেওয়ার সময় যখন প্রথম আসমানের দ্বার প্রান্তে পৌঁছাতেন সেই আসমান আপনার জন্য খুলে দেওয়া হতো না এবং আপনি প্রথমবার আল্লাহর কন্ঠ শুনতে পেতেন। কিন্তু সেই কন্ঠ হতো রাগান্বিত এক কন্ঠ এবং তিনি বলতেন, " ওর বই সিজ্জীনে নামিয়ে রাখো" এবং আপনাকে সেই প্রথম আসমানের দ্বার প্রান্ত থেকে ছুড়ে ফেলা হতো কবরের দিকে।
সেই ভয়ংকর পরিনতি আপনার হয়নি, কৃতজ্ঞতায় আপনার অন্তরটা ভরে যায়৷ আপনি সেই কবরের ভেতর থেকে শুনতে পান আপনার কাছের মানুষেরা কবর দেওয়া শেষ করে ধীরে ধীরে চলে যায়। আপনি প্রথমবারের মতো একা হয়ে পরেন, অন্ধকার কবরে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ এবং তখনই আপনাকে উঠিয়ে বসানো হয়।
আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে দেখতে ভয়ংকর দুইজন ফেরেশতা। তাদের দেখে ভয় লাগলেও আপনি জানতেন মুনকার আর নাকির আসবেই। আপনি জানতেন এখন প্রশ্নোত্তরের পালা এবং ঠিকমতো জবাব দিতে পারলেই আপনার আর কোনোই ভয় নেই।।।
পরবর্তী আলোচনা দ্বিতীয় পর্বে হবে।ইনশা আল্লাহ্।

কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.