আল্লাহর কাছে আসার গল্প,

(লেখিকার পাঠানো লেখা হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে)
আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ...
কোনকিছু এতো ভালোবেসে লেখা যায় তা আমার আগে জানা ছিলো না...আজ হেদায়াতের কথা লিখতে গিয়ে অজানা এক ভালোলাগা কাজ করছে..হয়তো এখনও ঠিক সেভাবে ফেরা হয়নি আমার রবের কাছে,যেভাবে ফেরার কথা ছিলো,,কিন্তু তবুও আলহামদুলিল্লাহ হেদায়াতের স্বাদ আমি পেয়েছি,,আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করছি.."হেদায়াত" শব্দটির কথা মনে হলে বা নিজের ভেতর এই পরিবর্তন দেখে মনের গভীর থেকে ”আলহামদুলিল্লাহ'” শব্দটি ভেসে আসে..
.

জন্মের পর থেকেই অভাবের তাড়না আর বাবা মায়ের ঝগড়াঝাটি নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো...অবস্থানে সবার ছোট ছিলাম বলে বড়দের কষ্টটা কিছুটা বুঝতাম,,আপুদের ত্যাগ,,আমার এতো মেধাবী ভাইয়াদের ঝরে পড়া,,ঘরে টাকার অভাব,,ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার জন্য সব জায়গা জমি বিক্রি,,কিন্তু যাওয়া হয় নি,,উপরন্তু বোনের বিয়ের জন্য মায়ের সব গয়না,,বোনদের গয়না বিক্রি,, আত্নীয়দের তাড়িয়ে দেওয়া,,তিরস্কার করা,,এর ওপর কাউকে না জানিয়ে ভাইয়ের বিয়ে করার ফলে নানা কথা শুনা ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনাগুলো চোখের সামনে সচরাচর ঘটতেই থাকতো..যদিও বয়স কম হওয়ায় আমাকে এইগুলো নিয়ে ভাবতে হতো না...তবে এগুলো আমাকে খুব স্পর্শ করতো...ভাবতাম আমি তো ক্লাস ৫ এ...যখন আমি ৮ এ উঠবো তখন হয়ত ভাইয়া বিদেশ গিয়ে অনেক টাকা পাঠাবে,,আমরা ইনেক সুখী হবো,,আম্মু আব্বুও টাকা পয়সা নিয়ে ঝগড়া করবে না আর...আত্নীয়রাও আমাদেরকে আর তীরস্কার করবে না,,আর কখনো কারো হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না...কিন্তু নাহ! তা আর হলো না..ক্লাস ৫ পেরিয়ে ৮ পেরিয়ে আমি কলেজে পা দিলাম..দুখ কষ্ট আর পিছু ছাড়ে না...বোনদের বিয়ে দিয়ে নিঃস্ব অবস্থা...অনেক কষ্ট করে কলেজে ভর্তি হলাম..তারপর শুরু হলো প্রতিদিনের ভাড়া নিয়ে ঝামেলা..পড়া একদম শেষ শেষ এর পর্যায়ে...তখন বাবা মা ডিছিশন নিলেন আমাকে নানুবাড়ি পাঠিয়ে দিবেন..বাড়ি থেকে কলেজে যেতে আসতে লাগতো ২০ টাকা,,সেই ২০ টাকা সপ্তাহে ৩ দিন বের হতো না,,,আর নানুবাড়ি থেকে যাতায়াত খরচ লাগতো ১০ টাকা,,তাই নানুবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আমাকে...😓
.
২০১৩ সালের শুরু থেকেই আমার নানুবাড়ির জীবন শুরু,,সেইসাথে শুরু সংগ্রামী জীবন...
একটি মেয়ের জীবনের রঙীন স্বপ্ন যে সময় শুরু হয়,,সেই সময়টাই আমার জীবনের সবথেকে কলুষিত সময় ছিলো...নানু মামি আর খালার অবহেলা,,তিরস্কার,,খারাপ ব্যবহার আর অপমানই ছিলো আমার নিত্যদিনের সংগী...কাজের মেয়ের মতো খাটুনী,, পড়তে না দেয়া,,কথায় কথায় অপমান এগুলো নিয়েই আমার বাঁচা ছিলো..বাবার পয়সা নেই বলেই আমাকে পরের বাড়ি এভাবে বড় হতে হলো...স্বপ্নগুলো এভাবেই শুরু হওয়ার আগেই ঝরে পড়লো...আমার বয়সি আমার মামার মেয়ে ছিলেন,,একইসাথে পড়তাম...কিন্তু অর দুনিয়া আর আমার দুনিয়ার মাঝখানে ছিলো এক আকাশ ব্যবধান...ও ঘুম থেকে উঠতো দেরি করে,,উঠতেই মা অর জন্য খাবার নিয়ে হাজির হতো,,মুখে তুলে খাইয়ে দিতো,,কলেজ এর জন্য রেডি করে নিজ হাতে চুল বেঁধে দিতো,,তারপর কলেজ এর গাড়ি এসে অকে নিয়ে যেতো,,আর আমি? আমি সেই সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর বাইর সব ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে,,নানুর কাপড় ধুয়ে,,মামিকে রান্নাঘরে সাহায্য করে,,খালার মেয়েগুলোকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে,,কাপড় পরিয়ে স্কুলের জন্য রাস্তায় নিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে সবাইকে সকালের খাবার খাইয়ে,নিজে খেয়ে রেডি হয়ে অনেক জায়গা হেটে মেইন রোডে গিয়ে গাড়ির জন্য অনেকক্ষণ দাড়িয়ে ,, কখনো বা পুরুষের সাথে বসে কলেজে যেতে হতো...ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস..কলেজে যাওয়ার সময় কেউ ভাড়া ব্যতীত এক পয়সাও দিতো না,,টিফিন টাইমে খাওয়ার জন্য মনটা বড় ছটপট করতো...প্রতিদিন ঘরে ফিরে এসেই ঠিক একইভাবে কাজ করতাম...রাতে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে যখন ঘুমাতে যাবো তখন নানু বলতেন উনার হাত পা টিপে দিতে।এভাবে রাত ১-২ টা বাজতো,,তারপর ঘুমাতাম....এই কাজগুলো যে করতাম এতে আমার কোনো দুঃখ ছিলো না,,দুঃখ আমার একটাই ছিলো,,কাজে লেইট হলে,,কাজে ভুল হলে,,কাজে একটু হেরফের হলে আমাকে এতো কথা শুনানো হতো,,আমার বাবাকে নিয়ে কটুকথা বলা হত,,আমার ভাইয়ের চরিত্র নিয়ে উল্টাপাল্টাকথা শুনতে হত, আমার চরিত্রও এমন হবে,, ভাইয়ের মত নষ্ট হবো,,গরিবের মেয়ে হয়ে এতো ভাব কেনো এই কথাগুলাই শুনতে হত..আবার কলেজে যেতেও বাধা দেয়া হতো..ঘরে কিছু একটা নিখোঁজ হলেই আমাকে সন্দেহ করা হতো,,শুধু সন্দেহই নয়,,কোনো প্রমান ছাড়াই আমাকে অপমান করা হত,,অপবাদ দেওয়া হতো..এভাবেই কাটলো বছরের পর বছর...আমি কখনই কাউকে এসব বলতাম না,,ভাবতাম মা বাবা শুনলে কষ্ট পাবে,,আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে...বাবার খুব স্বপ্ন ছিলো ক্লাস ফাইভ আর এইটে স্কলারশিপ পাওয়া উনার এই মেয়েটা এইচএসসিতেও এসএসসির মতো রেজাল্ট ধরে রাখবে,,
কিন্তু এইচএসসিতে খুব একটা ভালো রেজাল্ট হয়নি..যদিও আমি আলহামদুলিল্লাহ যথেষ্ট ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম...তারপর শুরু হলো আমার ইউনিভার্সিটি লাইফ,,অনার্স সেকন্ড ইয়ারে ওঠার পর একজন সিনিওর ভাইয়ার সাথে পরিচয় হয়,,আলাপচারিতার এক পর্যায়ে অনেক ভালোই সম্পর্ক হয়,,উনাকে সব কথা শেয়ার করতাম,,উনি আমাকে খুবই সাপোর্ট করতেন..উনি সবসময় পর্দা করার জন্য বলতেন,,আমার সকল দুঃখ আমি উনার কাছে বলতাম..

.
তারপর আমার মামাতো বোনের বিয়ে হয়ে যায়,,আমাকেও বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়..আমার ইউনিভার্সিটি যাওয়ার খরচ উনারা আর দিতে পারবেন না,,আমিও চলে আসি বাড়িতে..আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই বিদেশ চলে যান,,আরেক বড় ভাই একটা চাকরি পান..আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ
এতোকিছুর পরেও কোথায় যেনো অশান্তি ছিলো ঘরের মাঝে,,অভাব পিছু ছাড়লো না..পড়াশোনাটা মোটামুটি চললো...এইভাবে এক পর্যায়ে আবারো নানুবাড়ি থাকার প্রয়োজন শুরু হলো..বড় আশা নিয়ে আবারো বাড়ি ত্যাগ করলাম,,ভাবলাম এইবার হয়তো সবাই ভালোবাসবে,,সবাই বুঝবে আমি অসহায়,, কিন্তু না।।।আবারো শুরু....সালটা ছিলো ২০১৮...
এই অবস্থার মাঝেই কেউ একজনকে আমার খুব ভালো লাগতো..হারাম সম্পর্কে জড়িয়েও জড়ানো হয়নি,,কারন পরিণয় হওয়ার আগেই জানতে পারলাম অর রিলেশন আছে অন্য একজনের সাথে সেটাও আমাকে খুব খুব কষ্ট দিলো...এভাবেই কাটতে থাকতো দিন,,তবে সিনিয়ার সেই ভাই আমার পাশে থেকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছেন প্রতিটা মুহুর্তে..
তো সেদিন ছিলো আমার বার্থডে,,আমাকে আমার দুই একজন ফ্রেন্ড কলেজে যাওয়ার পর উইশ করলো,, এই এতটুকুই,,তারপর ক্লাস করে আমার এক বান্ধবীর সাথে ব্যাংকে গেলাম,,সেখানে গিয়ে একটু লেইট হয়ে গেলো,,অর জরুরী কাজ ছিলো বলে..বিকেল ৪ টার আগেই নানুবাড়িতে এসে ডুকতেই দেখি খুব থমথমে অবস্থা.. কেউ আমার সাথে বলতেছে না,,হঠাৎ আমার মা আমাকে কল দিয়ে যা তা বলতে লাগলেন,,নানু নাকি কলেজে গিয়ে আমাকে খোঁজে পায়নি (যদিও উনি কলেজের ভেতর ডুকেন নি,,গেটে দাঁড়িয়ে আমাকে না দেখে চলে আসেন।আমি সেটা পরে সেই পরিচিত সিএনজি ড্রাইভারের কাছ থেকে জানি,,তাছাড়া নানু যেই টাইমে কলেজে যান সেই টাইমে আমি চার তলায় ক্লাসে করতেছিলাম),, তারপর আমাকে নাকি পায় নি,, আমি না কি কোন ছেলের সাথে কোথায় চলে গেছি..ইজ্জত ডুবিয়ে দিয়েছি..আমি কুনো কথা বলি না,,,চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তেই আছে..কাউকে হ্যা না কিছু বলতে পারি না,,বোন কল দিয়ে উনিও ইচ্ছেমতো কথা শুনালেন...আমি আবারো কথা বলি না..সেদিন খুব কেদেছি,,কেউ আমাকে বুঝলো না,,ফেরেশতার মত মানুষের ওপর অপবাদ দিলো..সিনিয়ার সেই ভাই আমাকে দুনিয়ার মায়া থেকে সরে আসার জন্য অনেক ইন্সপায়ার করলেন,,উনি আগে থেকেই ফুল পর্দা করার জন্য ইন্সপায়ার করতেন,,সেদিনও বললেন,বুঝালেন..উনার কথায় আমিও খুব ইন্সপায়ার্ড হলাম,,সেদিন উনি আমার চোখ খুলে দিলেন..
সেই রাত্রে আমি তাহাজ্জুদের সময় আচমকা ভাবেই জেগে ওঠি,,দেখি রাত ৩ টা..
সেই প্রথম বুঝলাম আমার রব আমাকে ডাকছেন...আমি ও আমার রবের কাছে মন প্রাণ খুলে সব বললাম,,আহ! সেই সেজদাহ,,সেই কান্না,,সেই কষ্ট,,সেই আর্তনাদ,, সেই ভাঙন আমার রব ছাড়া আর কে দেখেছিলো সেদিন...সেদিনই বুঝলাম তিনিই আমার রব,,সেদিনই বুঝলাম এ দুনিয়া আমার আসল ঠিকানা নয়,মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম,আর কারো গোলামি নয়,একমাত্র আমার রবের গোলামি করেই জীবনের শেষ দিনের অপেক্ষা করবো,,জান্নাতে গিয়ে সুখের দেখা পাবো..ইন শা আল্লাহ
.

ধীরে ধীরে শুরু করলাম পর্দা,,মাহরাম নন মাহরাম মানা শুরু করলাম,,ধরলাম রাসূলের পথ,,পেয়ে গেলাম অমূল্য রত্ন "হিদায়াত",,শুরু করলাম নতুন জীবন...
যদি এক বাক্যে বলি আমার হিদায়াতের গল্প তবে বলবো আমার রবের সেই বানীই আমার গল্পের সারাংশ~
" এবং তিনি তোমাকে পেয়েছেন পথহারা অবস্থায় অতঃপর পথ প্রদর্শন করলেন " (৯৩ঃ৭)

.আলহামদুলিল্লাহ
আজও আমার সংগ্রাম চলতেছে,,আজও আমি অসহায়,,আজও আমি দুঃখে কষ্টে জর্জরিত...তবে আজ আমি আর একা নই,,আজ আমি হেদায়াতপ্রাপ্ত,,আজ আমার সাথে রয়েছেন আমার রব,,রয়েছে সবর...
হয়তো এই সংগ্রাম আমার মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্ত পর্যন্ত চলতে থাকবে,,হয়তো এ দুনিয়ায় কখনই সুখের দেখা পাবো না,,হয়তো সব স্বপ্ন এভাবেই ভেংগে চুরমার হতে থাকবে,,কিন্তু তবুও আমার মাঝে এক ফোটা আফসোস কাজ করবে না..কেননা আমি তো এই দুনিয়ায় সুখ চাই না;আমি আঘাত চাই,,যে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হবে আমার হৃদয়,,যে আঘাত আমাকে আমার রবের আরো কাছে নিয়ে যাবে,,যে আঘাত আমাকে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত করবে..আমি নির্দিধায় আঘাতগুলোকে স্বাগতম জানাবো...
তাই তো মোনাজাতে আমার রবকে বলি,,"হে আমার রব,যত সংগ্রাম দাও,,যত কষ্ট দাও,,যত ভাঙন দাও,,সব মাথা পেতে নেবো,,তুমি শুধু বিনিময়ে আমাকে জান্নাতে তোমার ঘরের কাছে একটু ঠাঁই দিও,,একটু জায়গা দিও..”
আমার সেই মোনাজাতে আমি তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া রাখি যারা আমাকে শিখিয়েছে জীবনের মানে কি...
আজও আমি আমার মোনাজাতে রাখি সেই মানুষটিকে,হৃদয়ের গহীন থেকে দোয়া করি সেই মানুষটির জন্য,যে আমাকে দেখিয়েছে নতুন জীবনের সন্ধান...
.
আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল...😊

(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোন)


দ্বীনে ফেরার গল্প শেয়ারের আয়োজক
শামছুন্নাহার রুমি

1 টি মন্তব্য:

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.