আল্লাহর কাছে আসার গল্প

(লেখিকার পাঠানো লেখা হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে)
আসসালামু আলাইকুম।
আজ থেকে ২ বছর আগে হিদায়াত পাই আলহামদুলিল্লাহ।
জানিনা এই হিদায়াত আমি আজ পর্যন্ত কতোটুকুই ধরে রাখতে পারছি।
আমার বাবা হুজুর,ভাই বোনের মধ্যে আমি বড়,এবং রাগী,বদমেজাজি উশৃঙ্খল ছিলাম বেশ।
ছোট্ট থেকেই জানতাম শুধু নামাজ পড়া,আর মাথায় কাপড় দেওয়াটাই একজন মুসলিমের দায়িত্ব।
কেউ আমাকে কখনো নামাজ পড়ার গুরুত্ব, বা চুল ঢেকে রাখার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলে নি,
শুধু কথায় কথায় মেরে,হাত-পা ভেঙ্গেই বলা হয়েছে "আজ মাথায় কাপড় দিস নি কেন?
আজ নামাজ পড়িস নি কেন?"
এভাবে মারধোর করে কি কাউকে দ্বীনের বুঝ দেওয়া যায়?
আমাকেও দেওয়া যায় নি। যা করতাম তা শুধু ভয়েই,, মারের ভয়েই নামাজ পড়তাম,মাথায় কাপড় দিতাম ব্যাস এইটুকুই।
আর গান-মুভি, প্রচুর দেখা হতো।
আরে জানতামই এসব হারাম, বা এসব দেখলে চোখের জিনা,শেষ বিচারের দিন শাস্তি হিসেবে চোখ,কানে আগুনের শীশা ঢেলে দেওয়া হবে।
হুজুর পরিবারে থেকেও গাফেল ছিলাম,,আমার চারপাশটাই গাফেল ছিলো।
যা দেখছি তাই শিখেছি,
চারপাশের বোনদের থেকে এটা আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম কিভাবে ছেলে ফ্রেন্ড বানানো যায়,কিভাবে প্রেম করা যায়।
যাক এভাবে সেভাবে গাফেল জিন্দেগী আর মারধোর খেয়ে ১০ টা বছর আমার হেলায় চলে গিয়েছিলো।
এস.এস সি পরীক্ষার পর নানুবাড়ি পাঠানো হয় আমাকে,এখন থেকে এখানেই থেকে পড়ালেখা চালাতে হবে তাই।
আহ আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই,,,প্রচুর খুশি হই কেউ আর এক মাথার কাপড় দেওয়ার জন্য কথায় কথায় গায়ে হাত তুলবে না,হাত ভেঙ্গে দিবে না নামাজ না পড়লে।
যাক নানুবাড়ির দিনগুলো ভালোই কাটতে লাগলো,,,ফেইসবুকে একাউন্টস খুলা ছিলো,
একদিন হুট করেই একজনের সাথে পরিচয়,
অত:পর প্রণয়...দীর্ঘ কটা মাস হারামেই কেটে গেলো!
কিন্তু নানুবাড়ি আসার পর ইন্টার ফার্ষ্ট ইয়ারের লাস্ট থেকে ফেইসবুকে "মুসলিম নারী" গ্রুপের পড়াগুলো দেখে আমি নামাজের প্রতি মনোযোগী হই। মনোযোগী বলতে একেবারে পাঁচ ওয়াক্তই পড়া হয়। গ্রুপের বোনরা এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে বুঝিয়ে লিখতো তা আমার মনে গেঁথে যেত। আমার হেদায়েতের উসিলা এই গ্রুপটাই।
আল্লাহ গ্রুপের কার্যক্রমে যারা রয়েছেন সেই সকল আপুদের উত্তম জাঝা দান করুন।
দোয়া রইলো অসংখ্য,, আর বিশেষ করে জুমানাপুর জন্য ভালোবাসা অবিরাম,,গ্রুপের আরো সকল আপুদের জন্য ও ভালাবাসা রইলো।
আপনারা যদি না থাকতেন তাহলে আমার কি হতো,,আমার রব্ব আপনাদের উসিলায়ই আমাকে আজ আলোর পথ দেখিয়েছেন বলেই ভালো মন্দটা বুঝতে শিখেছি।
নইলে তো জ্যান্ত পশুর মতোই ছিলাম।
আল্লাহ মাফ করুক আমায়।
তো নামাজের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পর পরই কেমন যেন আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছিলাম আমি।
হঠাৎ ককরে একদিন শুনি ওর অন্যজনের সাথে রিলেশন,,তারপর রাগ, জেদ নিয়ে ব্রেকাপ।
কি কষ্ট……শয়তান মনে কতো কথা উঠিয়ে দেয়,আগের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে বিষ ছড়িয়ে দেয় ভেতরটায়।
গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করি তার সাথে কথা বলার,,কিন্তু নিজের আত্মসম্মানবোধটা প্রখর ছিলো,,তাই বলতে পারছিলাম না।
বারবার আল্লাহকে বলি,,কষ্ট তো কমে না।
ঘুমের ঔষধ একের উপ্রে খাই কিন্তু ঘুম তো হয় না,,কি এক অসহ্য যন্ত্রণা।
পরে নিজেকে আটকে রাখতে পারি নি,,আবার কথা বলে ফেলি,,এখন ফ্রেন্ডস হয়ে কথা বলি,
কিন্তু দিন যায় মনে শান্তি আসে না,,
আগের মতো নাই,,রিলেশনের পর ফ্রেন্ডশিপ বিষাক্ত লাগে,চারপাশ বিষাক্ত লাগে।
তাহাজ্জতের মোনাজাতে নিজের কষ্টের কথা বলি না কমে না কষ্ট,,,বাড়তেই থাকে।
পাগল পাগল লাগে নিজেকে।
একদিন রাতে কষ্টগুলো সহ্য হচ্ছিলো না,
বুকে কোরআন চেপে ধরে,,আর্তনাদ করে বলেছিলাম আল্লাহকে,,,,
"ইয়া আল্লাহ আমার কষ্ট হচ্ছে,,তুমি কি দেখো না?"আমার কষ্ট হচ্ছে আল্লাহ………
ব্যাস পরদিন থেকেই যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম আমি,,
গ্রুপের পোষ্টে দেখতে পেলাম রিলেশন হারাম,
খুব সুন্দর করেই মার্জিত ভাষায় আপুরা বুঝায়।
বুঝে গেছি আলহামদুলিল্লাহ।
পরদিন ওকে আনফ্রেন্ড করে দেই,
ফেইসবুকে বেপর্দা অন্য মেয়েদের পিক ছিলো সেগুলো ডিলিট করে দেই।
অদ্ভুত আমার কষ্ট হচ্ছিলো না,,আমি আনফ্রেন্ড করে দিব্যি ছিলাম,,কথা না বলেও দিন চলে যাচ্ছিল।
ব্যাস সমাপ্তি,,হিজাব দিয়ে মাথায় কয়েক প্যাচ দিতাম ফার্স্ট ইয়ার থেকেই,,কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের লাস্ট থেকেই নিকাবের গুরুত্ব বুঝি,,
মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বলি আজ থেকে নিকাব করবো তো কাল থেকেই,হয়ে উঠে না আর। তো একদিন আবারও নিকাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট পড়ি,,আহা আল্লাহ আমায় কিভাবে আস্তে আস্তে হিদায়াতের পথে এগিয়ে নিচ্ছেন,,,ওড়না নিয়ে নিকাব করে,এভাবে কয়েকদিন যায় তারপর মনে হয় এভাবে ঠিক হচ্ছে না নিকাব,মানুষ আড়চোখে তাকায়,সুন্দর লাগছে কমেন্ট ও করে ফেলে কতোজ তাহলে এই পর্দাটা আমার হচ্ছে না,,এভাবে একদিন পরিপূর্ণ পর্দা নিয়ে মুসলিম নারী
গ্রুপ থেকে আরেকটা পোষ্ট দেখি,,শুরু করি সেই থেকেই।
কলেজ যাই ছেলেরা সাইড দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়,
বাসের সিটে কোন পুরুষ বসে না পাশে,,আমি একা সিটে বসে থাকলেও পাশে বসে না।
কি সম্মান,,অনুভব করি তাকওয়ার পোশাক,আল্লাহকে ভালোবেসে গায়ে জড়িয়ে নেওয়ায়ই এই সম্মান।
তারপর আসে ছেলে ফ্রেন্ডস,,পর্দা করেও ছেলেদের সাথে কথা বলতে আমার হাশফাশ লাগে।
মনে হয় আমি কি পর্দা করছি? তাহলে ওদের সাথে কথা বলছি কেন?
দেখুন আপুরা কিভাবে আল্লাহ আমায় একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছেন।
প্রশ্নগুলো আল্লাহই কি করে মনে তুলে দিচ্ছেন।
দায়িত্ব আমায় খুঁজে বের করা এর উত্তর।
মাহরাম-গায়রে মাহরাম কি? কাকে বলে?
আমার বাপ দাদা কেউই বলে নি,,
এগুলো কি আমি জানতাম ও না।
ইসলামিক পোষ্টেরর মাধ্যমে জানতে পারি।
কষ্ট হচ্ছিলো ওরা আমায় হেল্প করতো,
কলেজ যেতাম না,নোট থাকলে ওরা ছবি তুলে ইনবক্সে পাঠাতো,,,মেয়ে ফ্রেন্ডসরা বরাবরই হেল্প করতো না,,ওদের থেকে হেল্প খুব কমই পেতাম। ভাবছিলাম যদি কথা না বলি,যদি আনফ্রেন্ড করে দেই তো কলেজের খবরাখবর পাবো কি করে? বা নোটসগুলো?
নিজের পড়ার খরচ চালাতে আমি টিউশনি করি তাই কলেজে যেতাম না,কলেজে পড়াটাও তেমন হতো না,তাই যাওয়া হতো না আরও।
কলেজে যাওয়া আসা পুরো ১০ টাকা,,ভাবতাম এই ১০ টাকা বাঁচিয়ে দিলে পরীক্ষা ফি,রেজিস্টার ফি দিতে পারবো।
কারণ পড়ার খরচটা বাবা দেন না,উনার কথা পড়া বাদ দেও!মায়ের কথায় পড়ি।
তাই চাল+ডাল বেচে টেচেই টেন পাশ করিয়ে নানুবাড়ি দিলেন নানুবাড়িরা পড়ার খরচ চালাবে বলে,,কিন্তু মানুষ নিজের চিন্তায় বাচে না টানবে অন্য বুঝাকে?
হাসলাম! এখানে এসে টিউশনি আমার আল্লাহ কয়েকটা যোগিয়ে দেন,,,ব্যাস সংগ্রামটা এখান থেকেই।
যদি ব্যস্ত না থাকতাম তাহলে হয়তো সব ভুলাটাও আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
অবশেষে নিজের সাথে অনেক বুঝাপড়া করে সব ছেলে ফ্রেন্ডসদের লিস্ট থেকে আনফ্রেন্ড করে দেই। এই ভেবে আল্লাহ সাহায্য করবেন,আল্লাহর জন্য এসব ত্যাগ কিছুই না।
প্রথম প্রথম কষ্ট হচ্ছিলো ভীষণ,কিন্তু একসময় ভুলে যাই,,,সিম চেঞ্জ করে ফেলি।
ছবি,গান ডিলিট করে ফেলি।
একটা গান ডিলিট করতে গিয়ে কেন জানি কলিজা কেপে উঠছিলো,,হাত কাঁপছিল গানটা ডিলিট করতে গিয়ে,,এতোটা পছন্দের ছিলো সেই গানটা,,,কিন্তু না চোখ বন্ধ দাতেদাত চেপে শুধু এটাই বলেছি,,"আল্লাহর সন্তুষ্টির আগে কিছুই না,,এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাত যদি দিয়ে দেন……আল্লাহ আমায় ক্ষমা করে দেন"
ব্যাস এটাও ডিলিট দিয়ে দেই,,,
কান্না আসছিলো গানটা ডিলিট দিয়া,,মন উশখুশ করছিলো,,,একটা দিন পুরো আফসোস লাগছিলো গানটার জন্য।
পছন্দের ছিলো ভীষণ। তারপর ও সহ্য করে নেই,,এবং একেবারে সেদিন থেকেই গানের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যায়, এখন এমন কোথাও বাজনা গান শুনলেই মেজাজ বিগড়ে যায়।
রাগি,জেদি আমিটাও একদম বদলে যাই।
আমার পর্দা পরিবারেরর অনেকেই মানতে পারছিলেন না,,অনেকের অনেক কটুক্তি শুনতে হয়েছে,হচ্ছে।
হুজুর পরিবার থেকেও এমন কটুক্তি পর্দা নিয়ে শুনবো ভাবিনি,,,
যাক সেদিন থেকে নামাজে জন্য আর মার খেতে হয় নি আমায়,,,আর মাথায় কাপড় না দেওয়ার অপরাধে কেউ আঘাত করে না মাথায়।
আগে মানুষকে ভয় পেয়ে নামায, মাথায় কাপড় পড়তাম,,,
আর এখন আমার রব্বকে ভয় পেয়ে,তাকে ভালোবেসেই আমার মাথায় কাপড় সবসময়ই থাকে।
বাচ্চাদের দ্বীন শিখাতে চান? অনুরোধ করবো বাবা-মায়েদের মারধোর করে দ্বীন শিক্ষা দিবেন না। সন্তানকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দ্বীনের শিক্ষা দিন।
নইলে আমার মতোই গাফেল হয়ে যাবে,,
রব্ব যদি আমায় হিদায়াত না দিতেন আজও হয়তো মানুষের ভয়ে নামাজ পড়তাম।
কিন্তু রব্ব আমার দিকে দয়ার দৃষ্টি দিয়েছেন,তাই জাহেলিয়াত থেকে ফিরতে পেরেছি।
সবশেষে অসংখ্য জাঝাকিল্লাহ "মুসলিম নারী" পরিবারকে………
আমার জন্য দোয়া করবেন আপুরা,,
আল্লাহ যেন হেদায়েতের পথে আমায় অটল রাখেন।
ও সুন্দর,ঈমানী মৃত্য নসীব করান।
(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোন)
দ্বীনে ফেরার গল্প শেয়ারের আয়োজক
শামছুন্নাহার রুমি





কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.