এসো জান্নাতের পথে-৫

জঘন্য অতীতের অধিকারী অনেকেই 

তৈরি করেন সবচেয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ





আবু সুফইয়ান......
তিনি ছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই। তাঁর বাবা হারিস এবং রাসুলের পিতা আব্দুল্লাহ, দুজনেই ছিলেন আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান। বয়েসের দিক থেকে আবু সুফইয়ান রাসুল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমবয়সী ছিলেন এবং দুজনই একই সময়ে হালিমাহ আস-সা'দিয়াহ (রা) এর দুধ পান করেছিলেন।
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়তের লাভ করার আগ পর্যন্ত ছিলেন আবু সুফইয়ানের সবচেয়ে কাছের মানুষ। সমবয়সী দুজন, একই দাদার নাতী তারা, একই সাথে বেড়ে ওঠা, এসব কারনে দুজনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল গাঢ় বন্ধুত্ব। আর তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নবুওত লাভ করলেন, সবারই ধারণা ছিল, আবু সুফইয়ান হবেন সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহনকারী। রাসুলের ডাকে সাড়া দানকারীদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসরদের একজন হবেন তিনি।
কিন্তু ঘটলো এর বিপরীত। সবার ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রাসুলের সবচেয়ে বিদ্বেষীদের একজন হয়ে উঠলেন আবু সুফইয়ান। এমন কোন পন্থা তিনি বাদ রাখলেন না, যার দ্বারা মুসলিমদের কষ্ট দেয়া যায়। তাদের বিপদে ফেলতে সব ধরণের চক্রান্তই তিনি করেছেন।
অবশেষে একদিন!
যেদিন তিনি শুনলেন মক্কা বিজয়ের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা থেকে রওয়ানা দিয়েছেন, সেদিন তিনি প্রথমবারের মত অনুভব করলেন, তিনি হেরে গিয়েছেন। রাসুলের সাথে শত্রুতা করে আর কোন লাভ নেই। মক্কা বিজয়ের পর যাদেরকে হত্যা করা হবে, তাদের মধ্যে সবার আগে থাকবে তাঁর নাম।
পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলেন। পরিবার নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবেন। কিন্তু এই পরিবারই এবার তাঁকে বাধা দিল -
“এখনও কি হক কবুল করে নেয়ার সময় হয় নি। এখনো কি আপনার মনে হয় না, আপনার ভাই সত্যের উপর আছেন? কেন তাঁর কাছে যেয়ে ইসলাম গ্রহন করছেন না”? - আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্তরকে খুলে দিলেন। দিক পরিবর্তন করে রওয়ানা দিলেন আবওয়ার দিকে। যেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রা বিরতি করেছিলেন।
তাঁর ধারনা ছিল, তিনি ইসলাম গ্রহন করলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক খুশি হবেন। সাহাবিরাও তাঁকে কাছে টেনে নিবেন। কিন্তু এমনটি হল না। দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিমরা অপরিসীম এবং বর্ণনাতীত যে কষ্ট ভোগ করেছিলেন, তা যে মানুষটির কারনে হয়েছিল, তিনি ছিলেন এই আবু সুফইয়ান। রাসুল তাই তাঁর সাথে চোখে চোখ মেলাতে পারতেন না। তাঁর সাথে প্রয়োজনের বেশি কথাও বলতেন না।
আবু সুফইয়ানও বুঝতেন রাসুলের এই কষ্ট পাওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে। আজ তিনি মুসলিম, পরিপূর্ণভাবেই ইসলাম তাঁর ভেতর জায়গা করে নিয়েছে। আর তাই তিনি সবসময়ই এই চিন্তায় চিন্তিত থাকতেন, কিভাবে রাসুলকে খুশী করবেন। মাঝে মাঝে তাঁর ঘরের দরজায় যেয়ে বসে থাকতেন। হয়তো রাসুল তাঁকে দেখতে পেয়ে ঘরে ডেকে নিবেন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই এমন জায়গায় যেয়ে দাঁড়াতেন, যেখানে দাঁড়ালে তাঁর প্রতি রাসুলের দৃষ্টি পড়বে। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। কোনভাবেই তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন জয় করতে পারছিলেন না।
অবশেষে এলো সেই সুযোগ.........
হুনাইনের যুদ্ধে অন্যান্য সাহাবীদের সাথে আবু সুফইয়ান (রা)ও অংশগ্রহণ করলেন। মনে মনে সংকল্প ছিল, আজ এমন কিছু করে দেখাবেন, যাতে করে তাঁর প্রতি রাসুলের সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যায়।
যুদ্ধের একটি পর্যায়ে কাফিরদের পক্ষ থেকে যখন প্রবলভাবে তীর বর্ষণ শুরু হল, সমস্ত সাহাবিরাই বিভিন্ন আড়ালে আশ্রয় নিয়ে নিলেন। এদিক সেদিক যে যেদিকে পারলেন লুকিয়ে গেলেন। কেবল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ময়দানে। আর তাঁর খচ্চরের পাশে ছিলেন মাত্র দুজন ব্যক্তি। আব্বাস (রা) ও আবু সুফইয়ান (রা)। নিজেদেরকে ঢাল বানিয়ে লড়াই করে চললেন দীর্ঘক্ষণ। রাসুলের গায়ে সামান্য আঁচড়ও লাগতে দিলেন না তারা।
পরিস্থিতি যখন শান্ত হল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান (রা) এর ব্যাপারে অন্যান্যদের জিজ্ঞেস করলেন, কে ইনি? একজন জবাব দিলেন, আপনারই ভাই,আবু সুফইয়ান। ইয়া রাসুলাল্লাহ, এবার আপনি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।
স্মিত হেসে রাসুল জবাব দিলেন, ইতিমধ্যে সে তা আদায় করে নিয়েছে। সে আমার সাথে যত শত্রুতা করেছিল, আল্লাহ তা’আলা তা মাফ করে দিয়েছেন। ............খুশির তীব্রতায় আবু সুফইয়ান (রা) এর সেদিন মনে হয়েছিল তিনি যেন আকাশে উড়ছেন। চোখের পানি বাঁধ মানছিল না আর।
জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি নিজেকে রাসুলে সান্নিধ্যে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামও তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন পরম মমতায়। কিন্তু আবু সুফইয়ান (রা) এর মনে ছিল অনুশোচনা আর আফসোস। লজ্জায় তিনি কখনও রাসুলের দিকে তাকাতে পারতেন না। অতীতের কাজগুলোর জন্য তিনি সবসময়ই থাকতেন লজ্জিত।
অধিকাংশ সময়ই তাঁর কাটতো কুরআন তিলাওয়াতে বা নফল নামাজে। মসজিদের সাথে এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। একদিন আয়েশা (রা) কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, আয়েশা! ঐ যে মসজিদ থেকে বের হচ্ছে, লোকটাকে তুমি চিনো? আয়েশা (রা) নাসূচক জবাব দেয়াতে রাসুল বললেন,
তিনি হলেন আবু সুফইয়ান। সর্বপ্রথম মসজিদে প্রবেশ করেন তিনি, সবার শেষে বের হন। তাঁর দৃষ্টি কখনও জুতার ফিতার থেকে আলাদা হয় না। (অর্থাৎ সবসময় তিনি মাথা নিচু করেই রাখতেন)
উমর (রা) এর খিলাফতের সময়কালে তাঁর ইন্তেকাল হয়। ইন্তেকালের আগ মুহূর্তে তাঁর কাছের মানুষেরা যখন কাঁদছিল, তিনি বললেন,
তোমরা কেঁদো না। আল্লাহর কসম, ইসলাম গ্রহণের পর আমি কখনও কোন গুনাহ করি নি।
রাদিআল্লাহু আনহু ওয়া রাদু আনহ............
"Sometimes the people with the worst past create the best future."
-----------------
সূত্র –
১) আল-ইসতিআব ৪/৮৩
২) আল-ইসাবাহ ৪/৯০
৩) সিফাতুস সাফওয়াহ ১/৫৯১
৪) আল কামিল লিবনিল আসির ২/১৬৪
৫) আস সিরাহ আননাবউইয়াহ লিবনিল হিশাম ২/২৬৮
৬) সিয়ার আ’লামিন নুবালা ১/১৩৭
৭) আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৪/২৭৮








কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.