শ্রেষ্ঠ মানুষেরা -হযরত নূহ( আ:) [ পর্ব -৫]

হযরত নূহ( আ:)


একজন সন্তান যখন কোন ভুল কাজ করে তার বাবা-মা হয়তো তাকে শাসন করেন ।ধৈর্যশীল বাবা-মায়েরা প্রথমে বুঝিয়ে বলেন। একবার, দুবার ,বারবার বোঝান। কিন্তু কেউ যদি বুঝেও না বুঝে বারবার ভুল পথে ফিরে যেতে থাকে তখন বাবা-মায়েরা তাদেরই ভালোর জন্য হয়তো আরেকটু কঠিনভাবে বোঝাবেন ।একপর্যায়ে বকাঝকা ও করবেন।
একবার ভেবে দেখুন সেই সন্তান তার পরেও সেই ভুল পথ থেকে ফিরে আসছে না। মাসের পর মাস পার হতে লাগল। বছরের পর বছর পার হয়ে গেল। তার অন্যায় বেড়েই চলল ।একপর্যায়ে তার বাবা-মা হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। তারা ধরে নেবে এই সন্তানটি বকে গেছে। তীব্র হতাশা নিয়ে তারা হয়তো তার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিবে।
এবার ভেবে দেখুন এমন একজন বাবা যিনি তার সন্তানকে এত বেশি ভালবাসেন যে বছরের পর বছর ধরে তার সন্তান ভুল কাজ করে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি তাকে বোঝাতে থাকেন ।বারবার বোঝাতে থাকেন। দশ বছর পেরিয়ে যায় 20 বছর পেরিয়ে যায় তিনি হাল ছেড়ে দেন না ।সারাটা জীবন পার হয়ে যায় তিনি তাকে বুঝাতে থাকেন, বোঝাতে থাকেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে বোঝাতে থাকেন।একভাবে বলে কাজ না হলে চেষ্টা করে না অন্য কোনোভাবে সে সন্তান টিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা।
নুহ আলাই সালাম এর সাথে তার উম্মতের সম্পর্কটি ছিল অনেকটা এরকম ।তবে তিনি তাদেরকে 20-30 বছর ধরে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেননি বরং দীর্ঘ সাড়ে 900 বছর ধরে তাদের কাছে নিরলসভাবে আল্লাহর বাণী প্রচার করে গেছেন। আদম আলাইহিস সালাম ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মধ্যে দশটি প্রজন্ম ছিল ।বুখারির এই হাদিসে কার্ন শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে যার মানে হতে পারে প্রজন্ম অথবা শতাব্দি। অর্থাৎ নূহ আলাইহিস সালাম আদম আলাইহিস সালামের এর দশ প্রজন্মের পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
অথবা 1000 বছর পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ।

নূহ আলাইহিস সালামের সমাজে শিরক পড়েছিল গভীরভাবে ।ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাখ্যা থেকে আমরা জানতে পারি প্রাচীন সেই সমাজে কিছু ন্যায় পরায়ন ব্যক্তি ছিলেন যাদের নাম ছিল ওয়াদ,, সূয়া,, ইয়াগুছ,, ইয়াউক,এবং,নসর। কোনো কোনো উলামাদের মতে তারা ছিলেন শীষ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর ।যারা সমাজে ভালো কাজ করতেন। তারা মৃত্যুবরণ করার পর শয়তান এসে মানুষকে ওয়াস‌ওয়াসা দেয় এমন সম্মানিত ব্যক্তিদের কে যদি তোমরা মনে না রাখো তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম রা তাদের ব্যাপারে জানবে কিভাবে???
অতএব তোমাদের উচিত হবে তাদের মূর্তি তৈরি করা ।উপাসনা করার উদ্দেশ্য নয় বরং তাদের ভাল কাজগুলো করার উদ্দেশ্যে ।কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মদের গিয়ে শয়তান ওয়াসওয়াসা দিয়ে বলল তোমাদের পূর্বপুরুষরা এই মূর্তিগুলো কেই ইবাদত করতো। তোমরা যদি এমনটা না করো তাহলে তোমাদের উপর আল্লাহর গজব পড়বে।
নূহ আলাইহিস সালামের সময় এই মূর্তিপূজা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তিনি যখন এক আল্লাহর ইবাদতের বাণী প্রচার করছেন তখন সমাজের নেতারা বলল
وَقَالُوا۟ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا
উচ্চারণঃ ওয়া কালূলা- তাযারুন্না আ-লিহাতাকুম ওয়ালা- তাযারুন্না ওয়াদ্দাওঁ ওয়ালা-ছুওয়া-‘আওঁ ওয়ালা- ইয়াগূছা ওয়া ইয়া‘ঊকা ওয়া নাছরা- ।
অর্থঃ তারা বলছেঃ তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে।
এই কঠোর শিরকি সমাজে আল্লাহ নূহ আলাইহিস সালামকে পাঠালেন সত্যের বাণী প্রচার করার জন্য ।তিনি ছিলেন সেই সমাজের একমাত্র প্রকৃত বুদ্ধিজীবী ।যিনি শির্কের এই ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন ।এবং তিনি মানুষকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন তিনি বলেন
قَالَ يَٰقَوْمِ إِنِّى لَكُمْ نَذِيرٌ مُّبِينٌ
উচ্চারণঃ কা-লা ইয়া- কাওমি ইন্নী লাকুম নাযীরুম মুবীন।
অর্থঃ সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্যে স্পষ্ট সতর্ককারী।
আমি তো দূর দেশের কোন আগন্তুক ব্যাক্তি নই। আমি তোমাদেরই মাঝে জন্ম নিয়েছি ।তোমরা সবাই আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ।তোমরা আমার সতর্কবাণী শোনো ,,,
أَنِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَٱتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ
উচ্চারণঃ আনি‘বুদুল্লা-হা ওয়াত্তাকূহু ওয়া আতী‘ঊন।
অর্থঃ এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ তা’আলার এবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর।
অর্থাৎ আল্লাহ যেহেতু আমাকে তোমাদের রাসূল হিসেবে বেছে নিয়েছেন তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং আল্লাহর এবাদত কিভাবে করতে হবে তা জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমাকে অনুসরণ করা।আমরা লক্ষ করে দেখবো গোটা মানব ইতিহাস জোড়ে মানুষের একজন স্রষ্টাকে এবাদত করা নিয়ে তেমন কোন সমস্যা ছিল না ।বেশিরভাগ সময় তাদের সমস্যা ছিল এই নিয়ে যে ,তাদেরই মতো একজন মানুষ যে কিনা তাদের সমাজে জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের মাঝে বেড়ে উঠেছে, সেই মানুষটিকে রসূল হিসেবে মেনে নেয়া। শেষ নবী রাসুল সাঃ এর ক্ষেত্রেও জাহেলি আরবদের মাঝে এই সমস্যাটি ছিল প্রবল। তাদের আল্লাহর এবাদত করা নিয়ে আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে ই তাদের যত সমস্যা ছিল ।
কিন্তু বাস্তবে আল্লাহর এবাদত কিভাবে সঠিকভাবে করতে হবে তা কি আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানেন ???এবং তিনি যদি একজন মানুষকে বাছাই করে নেন তাঁর বাণী নাযিল করার জন্য এবং মানুষকে হুকুম করেন সেই ব্যক্তি কে অনুসরণ করার জন্য ।তখন সেই ব্যক্তিকে রাসূল হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া কি আল্লাহর এবাদত করার কোন উপায় থাকতে পারে??
নূহ আলাইহিস সালামের লোকেরা তাকে প্রত্যাখ্যান করলো তারা তার সাথে কেমন আচরণ করতো তা বিস্তারিত ভাবে সুরা নূহে উল্লেখ করা হয়েছে ।শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নূহ আলাইহিস সালাম যখন তাদের কাছে তাওহীদের বাণী প্রচার করে এসেছেন এবং তারা তার কথায় কান দিচ্ছিল না। নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে আক্ষেপ করে বলেন
قَالَ رَبِّ إِنِّى دَعَوْتُ قَوْمِى لَيْلًا وَنَهَارًا
উচ্চারণঃ কা-লা রাব্বি ইন্নী দা‘আওতুকাওমী লাইলাওঁ ওয়া নাহা-রা- ।
অর্থঃ সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি দাওয়াত দিয়েছি;
فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَآءِىٓ إِلَّا فِرَارًا
উচ্চারণঃ ফালাম ইয়াঝিদহুম দু‘আঈইল্লা-ফিরা-রা-।
অর্থ: কিন্তু আমি তাদের যত ডেকেছি তারা তত বেশি আমার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে।
وَإِنِّى كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوٓا۟ أَصَٰبِعَهُمْ فِىٓ ءَاذَانِهِمْ وَٱسْتَغْشَوْا۟ ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا۟ وَٱسْتَكْبَرُوا۟ ٱسْتِكْبَارًا
উচ্চারণঃ ওয়া ইন্নী কুল্লামা-দা‘আওতুহুম লিতাগফিরালাহুম জা‘আলূআসা-বি‘আহুম ফীআ-যানিহিম ওয়াছতাগশাও ছিয়া-বাহুম ওয়া আছাররূ ওয়াছতাকবারুছ তিকবা-রা- ।
অর্থঃ আমি যতবারই তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, যাতে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, ততবারই তারা কানে অঙ্গুলি দিয়েছে, মুখমন্ডল বস্ত্রাবৃত করেছে, জেদ করেছে এবং খুব ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছে।
আমরা কারো সাথে কথা বলার সময় যদি সে আমাদের দিকে না তাকায় বিরক্ত হয়ে তাকায়,এতে আমরা কতটা ক্ষুব্ধ হয়ে যাব ।সেই জায়গায় যদি কেউ,,আমরা কেউ কথা বলতে গেলেই তাদের কানের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয় মানুষের সম্মানের কতটা আঘাত পৌঁছায় ভাবা যায়???
এবং তিনি আরো বলেন তারা তাদের কাপড় দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেলত ।যেনো নূহ আলাইহিস সালাম এর কথা না শুনতে হয় ।
আল্লাহু আকবর।

সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি টি আপনার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন আপনি কেয়ামতের জীবনে বেঁচে যান, যেন আপনি আল্লাহর ক্ষমার লাভ করতে পারেন ,যেন আপনি হেদায়েত পেয়ে যান ।আর আপনি তাকে দেখার সাথে সাথেই ভাবেন ওই যে নুহ আসছে। তাড়াতাড়ি মুখে কাপড় প্যাচিয়ে ফেলি যেনো আবার এসে আবারো প্যাচপ্যাচ শুরু করে না দেই।
এবং তিনি আরো বলেন তারা দিন দিন আরো অহংকার করতে লাগলো।
ثُمَّ إِنِّى دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا
উচ্চারণঃ ছু ম্মা ইন্নী- দা‘আওতুহুম জিহা-রা- ।
অর্থঃ অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি,
ثُمَّ إِنِّىٓ أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا
উচ্চারণঃ ছু ম্মা ইন্নীআ‘লানতুলাহুম ওয়া আছরারতুলাহুম ইছরা-রা-।
অর্থঃ অতঃপর আমি ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি এবং গোপনে চুপিসারে বলেছি।
অর্থাৎ নূহ আলাইহিস সালাম বিভিন্নভাবে তার লোকদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন ইসলাম গ্রহণ করার। তিনি জনসমক্ষে আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন যেন কেউ সে বাণী শুনা থেকে বঞ্চিত না হয় ।আবার মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে আলাদাভাবে তাদের সাথে আলাপ করেছেন। যেন কেউ যদি সবার সামনে ইসলাম গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে তাহলে যেন অন্তত গোপনে তারা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে।
কিন্তু কোন লাভ হল না ।এবং তিনি তাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেন ।তিনি মানুষকে তার সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে বলেন ,,
مَّا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا
উচ্চারণঃ মা-লাকুম লা-তারজূনা লিল্লা-হি ওয়াকা-রা- ।
অর্থঃ তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহ তা’আলার শ্রেষ্টত্ব আশা করছ না।
সূরা নূহ (نوح), আয়াত: ১৪
وَقَدْ خَلَقَكُمْ أَطْوَارًا
উচ্চারণঃ ওয়া কাদ খালাকাকুম আতওয়া-রা- ।
অর্থঃ অথচ তিনি তোমাদেরকে ধাপে ধাপে সৃষ্টি করেছেন।
আমরা যখন চিন্তা করি আমরা কোথা থেকে এসেছি ?কিভাবে এক ফোটা তুচ্ছ তরল থেকে আমরা পর্যায়ক্রমে কত সুন্দর ভাবে গঠিত সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছি । এসব কি আপনাআপনি হয়েছে???
এবং আমরা নিজেদের সৃষ্টির বিস্ময়কর প্রক্রিয়ার দিকে তাকানোর পর যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই তাহলে আমরা আরো স্তম্বিত হবো নূহ আলাইহি সালাম বলেন
أَلَمْ تَرَوْا۟ كَيْفَ خَلَقَ ٱللَّهُ سَبْعَ سَمَٰوَٰتٍ طِبَاقًا
উচ্চারণঃ আলাম তারাও কাইফা খালাকাল্লা-হু ছাব‘আ ছামা-ওয়া-তিন তিবা-কা-।
অর্থঃ তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন।
وَجَعَلَ ٱلْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ ٱلشَّمْسَ سِرَاجًا
উচ্চারণঃ ওয়া জা‘আলাল কামারা ফীহিন্না নূরাওঁ ওয়া জা‘আলাশশামছা ছিরা-জা- ।
অর্থঃ এবং সেখানে চন্দ্রকে রেখেছেন আলোরূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপরূপে।
আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই এর বিশালতার সামনে আমাদের ক্ষুদ্রতা,, যখন আমাদের অন্তরকে কাঁপিয়ে তোলে তখন কি আল্লাহর মাহাত্ম্যের কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকে?? অথচ নূহ আলাইহিস সালামের এমন চিন্তার খোরাক জোগানো কথার উত্তরে মানুষ তাদের কানে আঙুল দিয়ে রাখত। কাপড় দিয়ে নিজেদের চেহারা লুকিয়ে রাখত ।নেতারা জনসাধারণকে বলে বেড়াত তোমরা কোন অবস্থাতেই তোমাদের দেব দেবীদের পূজা করা বন্ধ করবে না ।
আল্লাহ্ নূহ আ:কে লম্বা হায়াত দেওয়ার ফলে তিনি দেখলেন একের পর এক প্রজন্ম যেন আগের ছেয়ে বেশি অন্যায় এর পথে চলেছে।আল্লাহর বাণী কে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে।
এবং আমাদের বুঝতে হবে নূহ আলাইহিস সালাম কে আল্লাহ এমন এক জাতির কাছে পাঠিয়েছেন যারা মানব ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি গুলোর মধ্যে একটি। আল্লাহ সূরা নাজমে আদ এবং সামুদ সম্প্রদায়কে বর্ণনা করে বলেন তাদের পাপের কারণে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দেন ।এরপর তিনি নূহ আলাইহিস সালাম এর জাতির সম্পর্কে বলেন
وَقَوْمَ نُوحٍ مِّن قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوا۟ هُمْ أَظْلَمَ وَأَطْغَىٰ
উচ্চারণঃ ওয়া কাওমা নূহিম মিন কাবলু ইন্নাহুম কা-নূহুম আজলামা ওয়া আতগা-।
অর্থঃনুহের জাতি ছিল তাদের চেয়েও প্রাচীন ।এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই যে তারা অবশ্যই চরম জালেম এবং অবাধ্য প্রকৃতির মানুষ ছিল।
এখানে আরবি ভাষার দিকে তাকালে আমরা দেখব আল্লাহ তাদেরকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তিনবার জোর দিয়েছেন। প্রথমে তিনি বলেছেন ইন্না যার মানে নিশ্চয়ই ।এরপর কানু শব্দের পড়ে আবার হুম্ শব্দটি নিয়ে এসেছেন।যার মানে তিনি আবারো জোর দিয়ে বলছেন যে তারাই ছিল নিকৃষ্ট প্রকৃতির মানুষ। এবং তিনি জলেম শব্দটি না বলে আযলাম এবং আত্ব গা অর্থাৎ তারা শুধু জালেম ছিল না তাদের জুলুম এবং অবাধ্যতা ছিল মাত্রাতিরিক্ত।
আমরা জালেমদের আচরণ 10-15 বছর সহ্য করতে গেলে মনে হয় আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয় কবে কিয়ামত আসবে।আসলে এদের বিচার করবেন।অথচ চিন্তা করুন আমাদের সময়ের চেয়ে বহুগুণে নিকৃষ্ট নেতাদের কাছে সমাজের কাছে নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর পথে আহবান করেছেন দীর্ঘ সাড়ে ৯০০ বছর।
এবং বিস্ময়কর বিষয় হলো এমন একটি হতভাগা জাতির কাছে নূহ আলাইহিস সালাম এর বার্তা কি ছিল?
فَقُلْتُ ٱسْتَغْفِرُوا۟ رَبَّكُمْ إِنَّهُۥ كَانَ غَفَّارًا
উচ্চারণঃ ফাকুলতুছতাগফিরূ রাব্বাকুম ইন্নাহূকা-না গাফফা-রা-।
অর্থঃ অতঃপর বলেছিঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল।
সুবহানাল্লাহ্।
এমন জালেম সমাজকেও তিনি বলছেন আল্লাহর ক্ষমা থেকে হতাশ না হতে। এবং শুধু ক্ষমা নয় বরং তারা ফিরে এলে আল্লাহর তরফ থেকে তাদের জন্য বিরাট পুরস্কার অপেক্ষা করছিল।
يُرْسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا
উচ্চারণঃ ইউরছিলিছ ছামাআ ‘আলাইকুম মিদরা-রা- ।
অর্থঃ তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন,
বৃষ্টি মানেই আল্লাহর রহমত। বৃষ্টি মানে বেশি বেশি ফসল ফল ফলাদি।ইত্যাদি ।অথচ তারা নূহ আলাইহিস সালাম এর এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় অবশেষে এই বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করলেন। সুবহানাল্লাহ ।
তার পরিকল্পনার ওপর আর কোন পরিকল্পনাকারী কি হতে পারে ????
দীর্ঘ সাড়ে ৯০০ বছর দাওয়াত দেওয়ার শেষপ্রান্তে এসে নূহ আলাইহিস সালাম কে আল্লাহ বললেন তার দাওয়াতের পর্ব শেষ।তিনি তাকে একটি জাহাজ নির্মাণ করার আদেশ করলেন ।এবং বললেন যারা তার ডাকে তখন ও পর্যন্ত সাড়া দেয়নি তাদের ব্যাপারে যেনো নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে আর সুপারিশ না করেন।
কারণ তারা ধ্বংস হয়ে যাবে ।এটা নূহ আলাইহিস সালাম এর জন্য অত্যন্ত কঠিন একটা মুহূর্ত ছিল ।কারণ তার চার সন্তান হাম, সাম,ইয়াম এবং ইয়াফিসের মধ্যে একজন ইয়াম তার বাবার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই সাথে নূহ আলাইহিস সালামের স্ত্রীও তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল ।
তবু ও আল্লাহর আদেশ মতে নূহ আলাইহিস সালাম জাহাজ নির্মাণ করতে লাগলেন। সমাজের মানুষেরা ভাবলো নূহ আলাইহিস সালাম দ্বীনের কথা বলা ছেড়ে দিয়ে এখন নতুন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তারা তাকে নিয়ে উপহাস করতে লাগল। তিনি সাগর পাড় থেকে অনেক দূরে নৌকা তৈরি করছিলেন। তাই তারা তাকে বলল আরে নূহ নতুন নতুন নৌকা বানানো শুরু করেছো অন্তত সাগর পাড়ে গিয়ে নৌকা বানাও।তাহলে অতদূর পর্যন্ত নৌকা টেনে নিয়ে যাবে কিভাবে ??? নূহ আলাইহিস সালাম তার কাজ করে গেলেন এবং বললেন তোমরা আমাদের নিয়ে হাঁসাহাঁসি করছ একটা দিন আসবে যখন আমরা তোমাদের নিয়ে উপহাস করবো।
অবশেষে,আল্লাহর হুকুম প্রতিপালিত হলো। বৃষ্টি আরম্ভ হলো। বৃষ্টি দেখে হয়তো সে মানুষেরা প্রথমে খুশি হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি যখন একবার নামা আরম্ভ করল তার আর থামার কোন চিহ্ন নেই। আল্লাহর হুকুম মতে নূহ আলাইহিস সালাম বিশ্বাসিদের নিয়ে জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি নিয়ে সে জাহাজে উঠলেন। উঠার আগে শেষবারের মতো চেষ্টা করলেন তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু সে এতটাই জেদী আর এতটাই অবাধ্য ছিল,যে তার বাবা এতদিন ধরে নৌকা নির্মাণ করেছিলেন এটা দেখার পরেও এবং এরকম ভয়াবহ বন্যা আরম্ভ হওয়ার পরেও সে তার বাবার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বলল সে পাহাড় চূড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিবে তবু সে তার বাবার সাথে যাবে না।
অবশেষে বন্যা এমন উচ্চতায় পৌঁছলো গোটা পাহাড় পর্বত সমূহ পানিতে ডুবে গেল। এবং সেইসাথে পৃথিবীতে যত অবিশ্বাসী ছিল তারা ধ্বংস হয়ে গেল ।নূহ আলাইহিস সালাম নৌকায় আরোহণ করার সময় বললেন বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসাহা ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রাহীম।এবং পাহাড় সমান ঢেউয়ে করে নূহ আলাইহিস সালাম তার সাথীদের নিয়ে ভ্রমণ করলেন ।
অবশেষে আল্লাহর হুকুম দিলেন মাটি যেনো তার পানিকে শুষে নেয়। আর আসমান যেনো বৃষ্টি থামিয়ে দেয়।এবং নূহ আলাইহিস সালাম এর নৌকা জুদি পাহাড়ের সামনে এসে থামে ।
আল্লাহ নূহ আলাইহিস সালাম বলে ইয়া নূহ,, আমার নিরাপত্তায় অবতরণ করো।
এবং আমার বরকত তোমার ও তোমার উম্মতের উপর। এবং এমন কিছু সম্প্রদায় আসবে যাদের আমি কিছুদিন তাদের জীবন উপভোগ করতে দিব। কিন্তু তারপর আমাদের পক্ষ থেকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের স্পর্শ করবে। এবং কিছু উলামাদের মতে নূহ আলাইহিস সাল্লাম এর পুত্র সাম এর বংশধর এর মধ্যেই ভবিষ্যতে জন্মগ্রহণ করেন আমাদের জাতির পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম।


Baseera ইউনিউব চ্যানেল থেকে সংগৃহিত




1 টি মন্তব্য:

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.