শ্রেষ্ঠ মানুষেরা - হযরত শীথ ( আ:) পর্ব ৩

শ্রেষ্ঠ মানুষেরা - পর্ব ৩

হযরত শীথ ( আ:)


জীবনের যে বিষয়গুলো আমাদের জন্য কষ্টকর তাঁর মধ্যে সন্তান হারানোর বেদনা সবচেয়ে প্রবল, সবচেয়ে কঠিন। যখন আদম আ. সা. তাঁর সন্তান হাবীলকে হারালেন, তখন তাঁর কষ্ট কেমন ছিল তা হয়ত আমরা কল্পনাও করতে পারব না। কারণ বাস্তবে তিনি একই সাথে তাঁর দুই সন্তানকে হারিয়েছিলেন।কারণ হাবীলকে হত্যা করেছিলো তার আপন ভাই কাবীল এবং কাবীল তার এই নিকৃষ্ট কাজের অপরাধবোধের কারণে পালিয়ে গিয়েছিলো বহুদূর।

এবং হাবীল এমন এক বয়সে মারা গিয়েছিলেন যখন তিনি একজন টকবগে যুবক। তাঁর বিয়ে করে নতুন সংসার করায় বয়স। এবং তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। একজন যুবককে কেউ হত্যা করার হুমকি দেওয়ার পর তাকে কতটা বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে এটা বলার জন্য যে ‘তুমি আমাকে হত্যার করার জন্য হাত বাড়ালেও, তোমাকে হত্যা করার জন্য হাত বাড়াব না’। এমন একজন যুবকের মধ্যে আল্লাহ ভীরুতা কত প্রবল, এমন একজন সু-সন্তান হারানো যে কোনো বাবা-মায়ের জন্যই একটি বিরাট পরীক্ষা।

হযরত আদম আ. সা. ও মা হাওয়া কষ্ট পেলেন ঠিকই কিন্তু তাদের সবরে কোনো কমতি ছিল না। তারা আল্লাহর কদর মেনে নিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা তাঁর কাছেই জানালেন এবং তাদের এই সুন্দর সবরের বিনিময়ে আল্লাহ তাদের জন্য একটি সুন্দর উপহার পাঠালেন এবং সেই উপহার ছিলেন শীষ আ. যার নামের অর্থই হলো-উপহার বা পুরষ্কার।

শীষ আ. সম্পর্কে হযরত মুহম্মদ সা. কাছ থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

ইবনে হাব্বান বর্ণনা করেন, আবু জার আল গিফারি রা. একবার নবীজি সা. কে জিজ্ঞাসা করলেন আল্লাহ সর্ব মোট কতগুলো কিতাব নাজিল করেছেন। নবীজি সা. বললেন- তিনি সর্ব মোট ১০০টি সোহফ এবং ৪টি কিতাব নাজিল করেছেন। এবং এর মধ্যে ৫০টি সহিফায় কিতাব নাজিল হয়েছিল শীথ আ. কাছে।

আদম আ. মৃত্যুবরণ করার পর, শীষ আ. নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। অন্যদিকে পাহাড়ের নিচের অঞ্চলে কাবীল ও তার পরিবার তাদের মতো করে সমাজ গঠন করল। কাবীলের বংশ ধরেরা তাদের সমাজে নানা ধরনের অন্যায়, অনাচার ছড়াতে লাগল। অন্যদিকে শীষ আ. এর সমাজের লোকেরা আল্লাহকে ভয় করে সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে লাগল।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের মানুষের মত নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না। আর তোমরা সালাত কয়েম কর, যাকাত প্রদান কর। এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাক।
এই আয়াতের তাফসীরে ইমাম আত তবরী ইবনে আব্বাস রা. তায়ালা আনহুর মন্তব্য বর্ণনা করে বলেন, আদম আ. এর সন্তানদের মধ্যে একদল লোক থাকত পাহাড়ি অঞ্চলে, আর একদল লোক বাস করত সমতল ভূমিতে। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের অর্থাৎ শীষ আ. এর মানুষদের মধ্যে পুরুষদের সৌন্দর্য্য ছিল বেশি। কিন্তু নারীদের সৌন্দর্য্য তত বেশি ছিল না। অন্যদিকে কাবীলের সমাজের লোকদের বিষয়টি ছিল ঠিক তার বিপরীত। তাদের নারীরা ছিল তাদের পুরুষদের চেয়ে বেশি সুন্দরী।

এমন অবস্থায় ইবলিশ একটি তরুণের রূপ ধারণ করে কাবীলের সমাজে বাস করতে লাগল। সে একজন ধাতু কর্মীর সাথে কাজ করতে লাগল। এবং সেখানে কাজ করতে করতে ইবলিশ এমন একটি যন্ত্র তৈরি করল যা মানব সমাজ তখনও পর্যন্ত কখনও দেখেনি। এবং তা ছিল একটি বাঁশি। এবং সে সেই বাঁশি বাজাতে শুরু করল। এবং তা থেকে এমন এক ধ্বনি বের হতে লাগল যা মানুষ কখনও শোনেনি। এবং সেই ধ্বনি আশে-পাশের মানুষকে বিমোহিত করল। এবং তারা সপ্তাহের একটি দিন নির্ধারণ করল ইবলিশের সেই বিষ্ময়কর শব্দ একত্রিত হয়ে উপভোগ করার জন্য।

ভেবে দেখুন মানব ইতিহাসের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া এই প্রথা আজও প্রচলিত আছে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বিশেষ করে অমুসলিম সমাজে সেটারডে নাইট যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পার্টি। আর অনেক মানুষ সেদিন ক্লাবে গিয়ে থাকে এবং সেখানে এমন সব বাদ্য-যন্ত্র বাজানো হয়ে থাকে যা মানুষকে একটি মোহের মধ্যে ফেলে দেয়। এবং সেখানে যেন মানুষ সহজভাবে যিনায় লিপ্ত হতে পারে তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
কাবীলের বংশধরদের এই সপ্তাহিক আয়োজনের শব্দ শীষ আ. এর সমাজের কিছু মানুষদের কাছে পৌছায় এবং তারা একে অপরকে প্রশ্ন করে যে তারা কী করছে? এসব কেমন শব্দ। শীষ আ. তাঁদেরকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন আল্লাহ আমাদেরকে তাদের সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছেন। অতএব আমাদেরকে তাদের থেকে দূরত্ম বজায় রাখতে হবে। এবং তাঁরা এসে তওবা করার আগ পর্যন্ত তাদের সাথে আমাদের কোনো ধরনের মেলা-মেশা হবে না।

কিন্তু শীষ আ. তাদেরকে বারণ করা সত্ত্বেও তাঁর সমাজের কিছু মানুষেরা মনে করল, তারা তো আমাদেরই আত্মীয় তারা তো আমাদের শত্রু নয়! তারা কয়েকজন পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেল এবং তাদের সেই গান-বাজনার আয়োজন দেখতে লাগল। এবং সেই গান তাদেরকে আকৃষ্ট করল। এবং সেই সামাজের নারীরা তাদের আকৃষ্ট করল। তাদের নিজেদের সমাজে অর্থাৎ শীষ আ. এর প্রতিষ্ঠিত সমাজে তারা এত রূপবতী নারী কখনও দেখেনি। এবং কাবীলের সামাজের নারীরাও নতুন এই পুরুষদের দেখে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হলো। তারাও কখনও এমন সু-দর্শণ পুরুষ দেখেনি। এবং তারা তখন একটু একটু করে সেজে-গুজে বের হতে লাগল। এবং বেশি বেশি করে নিজেদের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করতে লাগল।

ইবনে আব্বাস রা. তায়ালা আনহুর মতে-

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে সূরা আহযাবে- তাবাররুজ বা সৌন্দর্য্য প্রদর্শন কথাটির মাধ্যমে এই কথাকেই বুঝিয়েছেন। এবং স্কলারদের মতে-মানব ইতিহাসে তখনই প্রথম মানুষ তার নিজের জীবন সঙ্গী ব্যতিত অন্য কারো জন্য তার সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করা আরম্ভ করে।

এবং এরপর তাই ঘটল যা হওয়া অনিবার্য ছিল। মানব ইতিহাসে প্রথম বারের মতো যিনা আরম্ভ হলো। মানুষেরা একে অপরের সাথে যিনা করতে লাগল। এবং দুই সমাজেই পাপ ও অনাচার বাড়তে লাগল।
এবং একই সময়ে ইবলিশ কাবীলের কাছে গেল এবং গিয়ে তার মনে ওয়াস-ওয়াসা দিতে লাগল। এবং সে তাকে বলল আল্লাহ তোমার ভাই হাবীলের কোরবানী কবুল করলেন। কিন্তু তোমার কোরবানী কবুল করলেন না কেন জানো? যখন হাবীলের কোরবানী কবুল হয়েছিল তখন আল্লাহর তরফ থেকে একটি আগুন এসে তার কোরবানীকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। এটাই ছিল তখনকার সময়ে আল্লাহর কাছ থেকে কোরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন।

কিন্তু ইবলিশ কাবীলকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল, হাবীলের কোরবানী কবুল হয়েছিল, কারণ হাবীলের ছিল আগুনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সে আগুনকে অনেক শ্রদ্ধা করত। তাই আগুন তার কোরবানীকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। কাবীল হয়ত মনের গভীরে জানত এই কথা গুলোর কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু মানুষ মাত্রই নিজের ভুল ত্রুটি মেনে নেওয়ার চেয়ে অন্য কারো ভুল ছিল বা পরিস্থিতি সুবিধার ছিল না, বা আমাদের প্রতি অন্যায় হয়েছে এই ধরনের গল্প বিশ্বাস করতে বেশি ইচ্ছুক। ইবলিশ মানুষের এই প্রভৃতি জেনেই কাবীলকে এই দিক থেকে তাকে বিভ্রান্ত করতে লাগল।

ইবলিশ তাকে প্রথমে নিজের ভাইকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। এরপর তাকে আল্লাহর ক্ষমা থেকে হতাশ করেছে। এবং এরপর তার মূল লক্ষ্য অর্জন করার জন্য কাবীলের মনে একটু একটু করে শিরকের বিষ ঢুকিয়ে দিতে লাগল।

কাবীল আগুনকে একটি পবিত্র বস্তু হিসেবে দেখতে লাগল। এবং একে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতে লাগল। এবং যদিও সে নিজে আগুনকে কোনো পর্যায়ে পুজা করেছিলো কি-না তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে অগ্নি পুজা হচ্ছে মানব ইতিহাসে শিরক করার সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যম গুলোর একটি। এবং কাবীলের সমাজ বড় হতে লাগল। এবং সেখানে অন্যায়-আনাচার বৃদ্ধি পেতে লাগল।

ইবনে আব্বাস রা. এর মতে – কাবীলের ভবিষ্যত বংশধরদের কাছেই আল্লাহ তায়ালা নূহ আ. কে পাঠান। এবং কাবীলের বংশধরদের প্রত্যেকেই নূহ আ. এর সেই বন্যায় ডুবে মারা যায়। আর নূহ আ. এর সাথে যারা তার জাহাজে উঠে ছিলো তারা সবাই শীষ আ. সা. এর বংশধরেরা। তবে নূহ আ. ও শীষ আ. এর মাঝখানে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য আরও একজন নবীকে পাঠিয়েছিলেন এবং সেই নবীর সাথে মেরাজের রাতে রাসূল সা. সাক্ষাত করেন।

পরবর্তীতে লিখব সেই নবীকে নিয়ে……….ইনশা আল্লাহ্।


Baseera ইউনিউব চ্যানেল থেকে সংগৃহিত






কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.