শ্রেষ্ঠ মানুষেরা -হযরত ইদরীস ( আ:) [ পর্ব - ৪]

শ্রেষ্ঠ মানুষেরা -[ পর্ব - ৪]

হযরত ইদরীস ( আ:)


আপনাদের নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মেরাজ ভ্রমণের গল্পটি মনে আছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি আসমানে একজন করে নবী- বা রাসূলের দেখা পেয়েছিলেন ।চতুর্থ আসমানে উনার কার সাথে দেখা হয়েছিল মনে আছে????
সূরা মারইয়াম,,,,
وَٱذْكُرْ فِى ٱلْكِتَٰبِ إِدْرِيسَ إِنَّهُۥ كَانَ صِدِّيقًا نَّبِيًّا
উচ্চারণঃ ওয়াযকুর ফিল কিতা-বি ইদরীছা ইন্নাহূকা-না সিদ্দীকান নাবিইইয়া-।
অর্থঃ এই কিতাবে ইদ্রীসের কথা আলোচনা করুন, তিনি ছিলেন সত্যবাদী নবী।
وَرَفَعْنَٰهُ مَكَانًا عَلِيًّا
উচ্চারণঃ ওয়া রাফা‘না-হু মাকা-নান ‘আলিয়া-।
অর্থঃ আমি তাকে উচ্চে উন্নীত করেছিলাম।
সূরা আম্বিয়া,,,,,
وَإِسْمَٰعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا ٱلْكِفْلِ كُلٌّ مِّنَ ٱلصَّٰبِرِينَ
উচ্চারণঃ ওয়া ইছমা-‘ঈলা ওয়া ইদরীছা ওয়া যাল কিফলি কুল্লুম মিনাসসা-বিরীন।
অর্থঃ এবং ইসমাঈল, ই’দ্রীস ও যুলকিফলের কথা স্মরণ করুন, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সবরকারী।
وَأَدْخَلْنَٰهُمْ فِى رَحْمَتِنَآ إِنَّهُم مِّنَ ٱلصَّٰلِحِينَ
উচ্চারণঃ ওয়া আদখাল না-হুম ফী রাহমাতিনা- ইন্নাহুম মিনাসসা-লিহীন।
অর্থঃ আমি তাঁদেরকে আমার রহমতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম। তাঁরা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ।
পবিত্র কোরআনে ইদরীস আলাইহিস সালাম এর ব্যাপারে এই দুটো আয়াতে এসেছে ।এবং বেশিরভাগ নবী-রাসূলদের মতো তার জীবন সম্পর্কে ও আমাদের জানতে হয় ইসলামিক ঐতিহাসিক ও স্কলারদের বর্ণনা থেকে। যা কোরআন এবং সহিহ হাদিসের মত নির্ভুল না হলেও আমাদেরকে এই আলোকিত ব্যক্তিত্বদের জীবন সম্পর্কে এটি সাধারণ ধারণা দেয়ার জন্য কার্যকরী।
সেই সাথে মনে রাখতে হবে ,যেহেতু এই মহান ব্যাক্তিত্ব দের ব্যাপারে কুরআন এবং সুন্নায় সরাসরি বিস্তারিত তথ্য নেই ।তাদের জীবনী নিয়ে স্কলারদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে ।এবং সাধারন মুসলিম হিসেবে আমাদের সেই মতপার্থক্যের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরী ।একদল স্কলারদের মতে ইদ্রিস আলাইহিস সালাম হচ্ছেন শীষ আ: ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মাঝখানে প্রেরিত নবী ।এবং তিনি হচ্ছেন আদম আলাইহিস সালামের নাতির ঘরের, নাতির ঘরের নাতি। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ৬ প্রজন্ম পাড় হয়েছিল ।
এবং অবাক করা বিষয় হচ্ছে যেহেতু তখনকার মানুষের হায়াত ছিল অনেক লম্বা। আদম আলাইহিস সালাম 900 বছরের ও বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।তাই স্কলারদের মতে ইদরীস আলাইহিস সালাম আদম আলাইহিস সালাম জীবিত অবস্থায় জন্ম হয়েছিলেন।আরেকদল স্কলারদের মতে ইদরীস আলাইহিস সালাম হচ্ছেন বনু ইসরাইলের জাতির নবী। যেহেতু আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সূরা মারইয়ামে ইদরীস আলাইহিস সালাম কে ইব্রাহীম ,ইসমাঈল ,ইসহাক, ইয়াকুব, হারুণ, মূসা, যাকারিয়া, ইয়াহ্হিয়া ও ঈসা আলাইহিস সাল্লাম দের সাথে উল্লেখ করেছেন ।
তাফসীর আল কূর্তুবিতে বর্ণিত আছে ইদরীস আলাইহিস সালাম হচ্ছেন ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি লেখার সূচনা করেন ।লিখা এবং পড়া যে আসলে কতটা সিস্ময়কর একটা ব্যাপার তা নিয়ে হইতো আমরা খুব একটাচিন্তা করি না। ভেবে দেখুন একজন ব্যক্তি একটি কাগজের মধ্যে কালি দিয়ে কিছু দাগ আকলো আর সেই দাগগুলো যেই দেখলো সে ব্যাক্তির মনের কথা গুলু বুঝতে পারল ।এবং এর ফলে শত শত বছর আগের গুণীজনেরা সরাসরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথে কথা বলতে পারছে। কি আশ্চর্য এক প্রক্রিয়া।লেখার মাধ্যমে জ্ঞান প্রসারের অবাক করা বিষয় এর দিকে আল্লাহ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে :সূরা আলাক্ব (العلق) এ বলেন:
ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ
উচ্চারণঃ অল্লাযী ‘আল্লামা বিলকালাম।
অর্থঃ যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
বর্তমান সময়ে মোবাইল এবং কম্পিউটার ছাড়া গোটা বিশ্ব অচল ।এবং এসব প্রযুক্তির মূলে রয়েছে মানুষের লেখা এবং পড়ার ক্ষমতা। এবং আল্লাহর নেয়ামতের জ্ঞানচর্চার এই অলৌকিক পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন ইদ্রিস আলাইহিস সালাম ।
সেই সাথে ইদরীস আলাইহিস সালাম ই আল্লাহর ইলহাম মতে বস্ত্র সেলাই শিল্পের সূচনা করেন। তার পূর্বে মানুষ সাধারনত পোশাক হিসেবে জীব জন্তুর চামড়া ব্যবহার করতেন ।আজ সেই বস্ত্রশিল্প এত এগিয়ে গিয়েছে যে এই বস্ত্র তৈরী কে কেন্দ্র করেই কোটি কোটি মানুষ তাদের জীবিকা আয় করে ।
ইদ্রিস আলাইহিস সালাম আরো আবিষ্কার করেন লোহা দিয়ে অস্ত্র তৈরীর পদ্ধতি।যার মাধ্যমে তিনি কাবিল গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ আরম্ভ করতে পারেন। এবং কিছু উলামাদের মতে তিনি ছিলেন প্রথম নবী ,যে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার বিষয়টি আরম্ভ করেন ।
আল্লাহ তাআলা যখন পবিত্র কুরআনে বলেন তিনি ইদরীস আলাইহিস সালাম কে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন এর মানে কি তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে ।
তার মৃত্যুর বিষয় একটি বর্ণনা আছে যেখানে বলা হয় তিনি এক ফেরেশতার বন্ধুত্ব করে চতুর্থ আসমানে মালাকুল মউত বা মৃত্যুর ফেরেশতার সাথে সাক্ষাৎ করতে যান।এবং মালাকুল মউত সে চতুর্থ আসমানেই তার আত্তা নিয়ে নে। আব্বদুলাহে্ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতে এই বর্ণনা গুলোর জন্য শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না । বরং এগুলো মূলত বনি ইসরাইলের মাঝে প্রচলিত গল্প।
আমরা শুধু এতটুকুই বলতে পারি ইদরীস আলাইহিস সালাম যে সময় দুনিয়াতে প্রেরিত হয়ে থাকেন না কেনো আল্লাহ তাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন। এবং তিনি মানব ইতিহাসের মধ্যে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
ইদরীস আলাইহিস সালাম এর সময়ের পর একটা লম্বা বিরতি থাকে। যখন কোন নবী রাসুল পাঠানো হয়নি ।সে সময় টাই শয়তান অত্যন্ত কুটিলএবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সমাজে পাপ ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই নেমে পড়ে।
মানুষ সে সময় লেখালেখি ও আঁকাআঁকি করতে পারে ।সে মানুষের সে দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তাদেরকে শির্কের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করে ।সে সময় কোন ধার্মিক মানুষ বা ভালো কোনো মানুষ মারা গেলে শয়তান বলতো মানুষটা কত ভাল ছিল। তোমাদের উচিত তাকে মনে রাখা। তোমরা তার একটা ছবি তো আঁকতে পারো ।নাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম র তাদের ব্যাপারে জানবে কিভাবে ???তার পরের প্রজন্মকে সে উদ্বুদ্ধ করল পূর্ণবান পূর্বপুরুষদের মূর্তি বানিয়ে ফেলার জন্য। তার পরের প্রজন্মকে সে বুদ্ধি দিল যে,শুধু মূর্তি বানিয়ে ফেলে রাখলে কি আর শ্রদ্ধা করা হলো??? তোমরা এই মূর্তিগুলোকে সিজদা করো।না,না এবাদত করার নিয়তে সিজদা করবে না ।শুধু শ্রদ্ধা করার নিয়তে সিজদা করবে ।এই দুটো জিনিস তো আর এক না।
তারপরের প্রজন্ম গুলো কে সে বলল দেখো ,তোমাদের বাবা-মা দাদা-দাদি রা এই মূর্তিগুলোকে পূজা করতো।তোমরা একইভাবে তাদের পূজা না করলে তোমাদের উপর আল্লাহর গজব পড়বে। এভাবে করে একটু একটু করে শয়তান মানবসমাজে শির্কের বিষ ঢুকিয়ে দেয়।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, শয়তানের মনে মানবজাতির প্রতি যে হিংসা তা এক ভয়াবহ হিংসা ।যা তাকে পুরোপুরি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে ।এই হিংসা এতো প্রবল যে,এর ফলে সে অকল্পনীয় রকমের ধৈর্য নিয়ে মানুষকে বিপথগামী করার মিশনে নেমেছে। তারই ধারাবাহিকভাবে মানুষকে ধোকা দেয়ার কৌশল আমাদের সবসময় মাথায় রাখা উচিত যেন আমরা নিজেদের সমাজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি শয়তান বর্তমান সময়ে কিভাবে কাজ করছে।এবং শয়তানের আরেকটি কৌশল হচ্ছে মানুষকে হতাশ করে ফেলা।
আমরা ভাবতে পারি চারিদিকে এত অন্যায় ,অনাচার ,চারিদিকে এত পাপ, এত জুলুম মনে হতে পারে বর্তমান বিশ্ব মনে হয় শয়তান ই নিয়ন্ত্রণ করছে ।এটা একটা ধোকা।কারণ গোটা মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহর হাতে। শয়তান শুধুমাত্র আমাদের মনে ফিসফিস করে কু -বুদ্ধি দিতে পারে। তার আমাদের উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই।
চারিদিকে অনেক অন্যায় অনাচার ছড়িয়ে পড়েছে ।এটা দেখে যেন আমরা মানুষের ভালো কাজ করার ক্ষমতার ব্যাপারে নিরাশ না হয়ে যায় ।কারণ মহাবিশ্বের রব তো আমাদের উপর নিরাশ হননি। এখনো আমাদের প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই মমতা ভরে দিয়ে যাচ্ছেন যেন আমরা তার দিকে ছুটে যাই, জান্নাতের দিকে ছুটে যায় ।অতএব শয়তানের কুমন্ত্রণা যেন আমাদের নিরাশ না করে ফেলে।

এই ঘটনা থেকে আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো প্রতিটি বিষয়েরই ভালো-খারাপ রয়েছে। আল্লাহ ইদরীস আলাইহিস সালামকে লেখার মাধ্যমে আল্লাহর বাণী প্রচারের জ্ঞান দিয়েছেন। শয়তান মানুষের সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আস্তে আস্তে শির্কের দিকে নিয়ে গিয়েছে। বর্তমান সময়ে আমাদের হাতেও রয়েছে অবাক করা সব প্রযুক্তি। সব ধরনের জ্ঞানী আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা চাইলে তা ইদরীস আলাইহিস সালামের উদাহরণস্বরূপ ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি। অথবা শয়তানের ওয়াসওয়াসা অনুযায়ী পাপ কাজে ব্যবহার করতে পারি।
মোবাইল ফোন , ট্যাব,টেলিভিশন,ফেসবুক,টুইটার, ইনস্টাগ্রাম,স্ন্যাপ চ্যাট আধুনিক জীবনের এই নিয়ামত গুলু থেকে আরম্ভ করে আমাদের চোখ,কান,হাত,পা কে আমরা কি কাজে লাগাচ্ছি । শয়তান সবসময় চেষ্টা করবে শির্ক কে আমাদের কাছে ভালো একটা কাজের মত করে তুলে ধরতে । শয়তানের এই চেষ্টা হতে পারে আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হওয়া বলিউডের গান ,বা কোন নেতার ছবি,বা কোনো বড় স্কলার এর ছবি,বা কোনো কবর বা এমনকি ধর্মীয় গানের মাধ্যমে।
শয়তানের এই ফাঁদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো আমাদের দ্বীনকে শুদ্ধভাবে জানা। এবং সর্বক্ষণ আল্লাহতালার কাছে শিরক এবং রিয়া থেকে আশ্রয় চাওয়া।
এরপরে যে নবীর জীবনী নিয়ে আমরা আলোচনা করব তার ব্যাপারে কোরআনে পুরো একটি নাজিল হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে 900 বছর ধরে তিনি মানুষকে ধৈর্য ও সহানুভূতির সাথে আল্লাহর পথে ডেকেছেন। তিনি সেই নবী যিনি আল্লাহর হুকুমে বিশাল আকারের এক জাহাজ তৈরি করেছিলেন ।যেন অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত শাস্তি থেকে বিশ্বাসীরা রক্ষা পান।
বলতে পারবেন কি??! তার নাম?

আগামী পর্বে তাকে কে নিয়ে আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ্।


Baseera ইউনিউব চ্যানেল থেকে সংগৃহিত




কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.