আল্লাহর কাছে আসার গল্প

(লেখিকার পাঠানো লেখা হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে)
আলহামদুলিল্লাহ্‌, আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আ'লামিন।
প্রথমে ই বলি এটা দ্বীনে ফেরার না,রাস্তা চেনার গল্প।দ্বীনে ফেরা হয়েছিল কি না তা আমলনামা হাতে পাওয়ার পর বুঝতে পারব,তখন জান্নাতে যেয়ে ফেরার গল্পটা শুনাব ইং শা আল্লাহ।
____________________________
ছোটথেকেই দেখেছি মা-বাবা কে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে।মাঝে মাঝে আমি আর আমার বড় ভাই ও দাঁড়াতাম নামাজে।যখন আমরা নামাজ শেষ করতাম দেখতাম আমাদের পিছনে ফল,খাবার রাখা।আম্মু বলতেন ফেরেশতা কে দিয়ে আল্লাহ পাঠিয়েছেন নামাজ পরার পুরস্কার। পরে বুঝি সেটা আম্মু ই করত,নামাজে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য।তখন আসলে আম্মু জানত না যে বাচ্চাদের সাথেও সত্যকথা বলতে হয়।তিনি তার মত চেস্টা করে গেছে আমাদের দুই ভাই-বোন কে নামাজ পড়াতে,কোরাআন পড়া শেখাতে।প্রতি বার ই আমার ভাই এর জন্য আরবী শিক্ষক রাখা হত আর শিক্ষক সমুহ একবছর যাবত হরফ ই চেনাত, যদিও ভাই সব অক্ষর উচ্চারণ ও লিখতে পারত।
কালক্ষেপণ করে টাকা নেয়ার এই অভিনব উপায়ে আম্মু তখন বিরক্ত।ওর কোরাআন শিখা তখন বাদ।
একদিন বাসার পিছনে খালের ওপারে এক মহিলা মাদ্রাসায় আমাকে শুধু সকালে সহিসশুদ্ধ কোরাআন শেখার জন্য দিল,এক,দেঢ় বছর শুধু আলিফ বা পড়ায়।যদিও ক্বফ থেকে শুরু করে 'হা' সব উচ্চারণ ই পারতাম তবুও আমায় একই পড়া দেয়,এবার আমিও বিরক্ত।প্রতিদিন যেয়ে বড় গ্রুপের সুরা মশক করত,শুনে বেশ কয়েকটা শিখে ফেল্লাম।তারপর আবার আব্বুর বদলী তে জায়গা বদল।ভাই ssc পাশ করে ঢাকা চলে গেল।আমি একা,কস্ট হত,খারাপ লাগত।বেশ কিছু ছোটখাট বিপর্যয় চলছে,আমি তখন ছন্নছাড়া।ভাই ভার্সিটির টপ স্টুডেন্ট, সাথে ট্রেন্ডি ও।ওর কাছ থেকেই ইংলিশ মুভি দেখা,গান শোনার হাতে খড়ি।Numb,Hazard,Walk Alone,Do u know আরও প্রচুর গান মুখস্ত।
হলিউড এর সেলেব দের ফলো করি,পোশাক-জিন্স,টপ্স।আমার বাবা-মা আসলে জানতেন মুসলিম হলে নামাজ রোযা করতে হয় নিয়মিত।পর্দার বিষয়ে তারা কিছুই জানত না।আমার মত এত ভাল ছাত্রী,(স্মার্ট!) মেয়েকে নিয়ে আমার আত্নিয়ের বুক গর্বে ভরে উঠত।বলা হয়নি আমি তখন মাঝে মাঝে নামাজ পড়তাম আমার এক বান্ধবীর প্রভাবে।ও ও নামাজ ধরত,ছাড়ত।আসলে আমরা আমলের বই দেখে আমল করতাম ৩০ দিন পড়লে আশা পুরন হয় টাইপ,আশা ও পুরন হয় না,আমরাও নামাজ বাদ দেই,এর মধ্যে হুজুর রেখে কোরাআন পড়া শেখাল।আমি জিন্স পড়ে,মাথায় কোনরকম Scarfs পরে পরতাম।একদিন একজন এ অবস্থায় দেখে হুজুর কে বল্ল আপনার ছাত্রীর এমন পোশাক কিছু বলেন না!
জবাবে হুজুরের উত্তর ছিল,একবারে সব ঠিক করতে গেলে কিছুই ঠিক হবে না।ইলম অর্জন করার পর ও নিজেই সব ছেড়ে দিবে।
আলহামদুলিল্লাহ, এখন বুঝি হেকমত পূর্ন দাওয়াহ কতটা কার্যকর!
তখন রাতে একা ঘুমাতে ভয় পাই,একদিন হঠাৎ মনে হল,ভয় পেলে আম্মু কে ডাকি চলে আসে,কিন্তু মৃত্যুর সময় তো কাউকে ডাকতে পারব না!কি অদ্ভুত অনুভূতি।
বিভিন্ন কারনে নামাজ পড়ি,ছাড়ি।Ssc তে ৫+ পাওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট এ ভর্তি হই।ফোনে একটা হারাম সম্পর্ক ও হয় কিন্তু দেখা করা সম্ভব ছিল না।অনেক কথা হত,কথা বলতে বলতে রাত শেষ।যদিও দেখা হত না কিন্তু সম্পর্ক টা চলল,বছরের পর বছর!জী,বছরের পর বছর____ আল্লাহুম্মাগফিরলি।
ইন্টারের পর রাজশাহী মেডিকেল এ চান্স হল কিন্তু এতদূর একা পড়তে বাসা থেকে ছাড়ল না,ভর্তি করল কাছের প্র্ইভেট ইউনিভার্সিটিতে Science faculty তে।আমি যে সাবজেক্ট এ পড়তাম তাতে অনার্স শেষ হলেই জব।কিন্তু আমি ভালবাসায়!এতই অন্ধ ওই জব করলে ঢাকা থাকতে হবে, আমার ইচ্ছা ছিল bf কে বিয়ে করে ওর সাথেই গ্রামে থাকা।এত ভাল সাবজেক্ট ছেড়ে ন্যাশনাল এ ভর্তি হলাম!!
এক ডাক্তার এর সাথে বিয়ের কথা হচ্ছিল, কিন্তু আমার তিব্র আন্দোলন এর মুখে বাবা-মা সে বারের মত বিয়ের আশা ছেড়ে দিল,আর ও তখন খুব করে চাকরি খুজছে,সারাদিন রাত এক করে পড়ে,চাকরী হলেই আমায় বিয়ে করে নিয়ে যাবে।তখন কয়েক মাস ও ঢাকায় ছিল কোচিং এর জন্য,জিবনে প্রথম কারো সাথে রিকশায় বসা,আইসক্রিম খাওয়া এটাই আমার জন্য অনেক,স্বপ্নের মত।
এর মধ্যেই একদিন নানু স্ট্রোক করলেন, কয়েকদিন পর মারা গেলেন।জিবনে অনেক মানুষের মৃত্যু দেখেছি,কিন্তু তখন মনে হল এই প্রথম আমি জানলাম মানুষ আসলেই মারা যায়,প্রথম অনুভব করলাম।নামাজ শুরু করলাম,নতুন ভার্সিটি তে ওড়না হিজাব পড়ে যাই,আর ততদিনে আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে,ভাবি ও মোটামুটি ধার্মিক,নিয়মিত নামাজ আদায় করে।ভাই ও নামাজ পড়ে নিয়মত,প্রইভেট ফার্মে জব করও দাড়ি,টাখনুর উপর প্যান্ট।সেদিনের ট্রেন্ডি ছেলে দেখে কে বলবে? (বারাকাল্লাহু লাকা)
নানু মারাযাবার কয়েকমাস পরেই ভাইয়ের মেয়ে বাবু হল,হার্টে ছিদ্র থাকায় খুব কস্টে ২দিন সব চেস্টা ব্যার্থ প্রমান হল।যেই হাত দিয়ে কোলে নিয়ে আগের দিন ছোট ফুটফুটে শরির টার নড়াচড়া দেখছিলাম পরের দিন সেই হাত দিয়ে ফুলের মত মিস্টি নিথর দেহখানি ধরেছিলাম, পরপর দুটি মৃত্যু নাড়া দিয়ে গেল।মনে হচ্ছিল স্পঞ্জ দিয়ে কেউ জিবনের সব রং শুষে নিয়েছে।বাসায় সবার মন খারাপ।নানু মারা যাবার পর থেকেই।
যখন হাইস্কুলে পড়তাম তখন থেকে ই জানতাম খ্রীস্টান ধর্মের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য, বিচের বিবেচনা করার পর মনে হল খ্রিস্টান ধর্ম অপূর্ণ যেটার পূর্নতা দেয় ইসলাম।আর হিন্দু ধর্ম নিয়ে অনেক সিরিয়াল,শো দেখার পর মনে হল হিন্দু ধর্ম কে আমার অযৌক্তিক মনে হল।এবার তখন ভাবা শুরু করেছিলাম হয় ইসলাম সত্য নাহয় কোন সৃষ্টি কর্তা নেই(নাউযুবিল্লাহ)কিন্তু যদি সৃষ্টি কর্তা না থাকে,পরকাল না থাকে তাহলে তো খুবই অন্যায়, দুনিয়ায় হওয়া অনাচারের বিচার হবে না!নাহ,অবশ্যই প্রতিপালক আছেন,তিনি তখন হ্রিদয়ে এটা বদ্ধমূল করে দিলেন,আলহামদুলিল্লাহ। (এটা স্কুলে পড়াকালীন সময়ের ভাবনা)কিন্তু এই ভাবনা পর্যন্ত ই সিমাবদ্ধ ছিল।
নানুর মারা যাওয়া পর ই নিয়মিত নামাজ শুরু করি আর তখন থেকে নিয়মিত পিসটিভি দেখে ইসলাম সম্পর্কে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছিল,তারপর হঠাৎ পিসটিভি বন্ধ হয়ে গেল, ভাইয়ের বাবুর মৃত্যুর কস্ট,অবসাদ সব মিলে একরাশ বিষন্নতা।কি মনে করে একদিন গুগোল এ হাদিসের বই খুজছিলাম,বুখারি ছাড়া কোন বই এর নাম জানতাম না,১০টা পার্ট ই ইফা: এর পিডিএফ ভার্সন নামিয়ে পড়া শুরু করলাম।ইসলাম নিয়ে জানছি আর হারাম রিলেশনে অশান্তি অনুভব করছি।ওর চাকরি হল,ভাবলাম এবার বিয়ে,ও ওর বাড়িতে জানাল,আমি আমার বাসায় বলার আগে একবার ইস্তেখারা করে নিলাম,স্বপ্ন টা বুঝলাম না তবে মনে করেছিলাম পজিটিভ।কিন্তু না,আমার বাড়িতে জানানোর আগেই বুঝলাম সে চলে যাবে,অন্য কাউকে বিয়ে করবে।!
যার জন্য আমার মত Ambitious একটা মেয়ে ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে,সব স্বপ্ন বিসর্জন দিল তার এই ব্যাবহার পুরোপুরি ভেংগে দিল আমাকে,ভাবলাম সব শেষ।মনে হল কেন এত ভাল সাবজেক্ট, ভার্সিটি ছেরেছিলাম। পরে বুঝেছি, আমার অন্তরের শূন্যতাই আমাকে আমার রবের কাছে এনেছিল,এসব ই আমার রবের নেয়ামত।আমি এখন জানি আল্লাহর সাথে বান্দার একটা সম্পর্ক থাকে,সিজদায় যেয়ে কেঁদে দুয়া করা কতটা শান্তির বুঝতে পারি।
সমস্ত প্রাশংসা সেই সত্ত্বার যিনি আমি হাজার,লক্ষ,কোটি ভুল করার পর ও রাস্তা দেখিয়েছেন, আমি যে ভার্সিটি তে পড়তাম প্রথমে, সেখানে হিজাব নিষিদ্ধ ছিল,যে কারোনেই ভার্সিটি ছাড়া হোক,ভালোই হয়েছে, নতুন ভার্সিটিতে পর্দা করে যেতে পারি,নামাজ পড়তে পারি সময়মত আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ বান্দাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন,তিনিই উত্তম পরিকল্পকারী।
এত নিয়ামত পাওয়ার যোগ্য আমি ছিলাম না,আল্লাহ দয়া করে দিয়েছেন।এখনো আমি চুড়ান্ত অবাধ্য-গাফেল, পারি না নেয়ামত এর শুকরিয়া আদায় করতে,তবু তিনি নেয়ামত দিচ্ছেন, মহান আমার আল্লাহ।পিছনের দিকে তাকালে বুঝি এই রাস্তা চেনায় আমার বিন্দু মাত্র কৃতিত্ব নেই,এই জার্নি শুধুই তার দয়া।কেবল পথচলা শুরু "ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি সাব্বিত ক্বলবি আলা দ্বীনিক"আমার বাবা-মা এখন ইসলাম সম্পরকে আগের চেয়ে বেশি জানেন,মানেন।আমার ভাইয়ের আবার একটা মেয়ে বাবু হয়েছে।
জীবনে পাওয়ার হিসেব না করে, না পাওয়ার হিসেব করতে থাকি আমরা।
কিসে কল্যান শুধু আল্লাহ জানেন।আমার লেখা দিব কিনা চিন্তা করতে করতে একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম লিখব,রবের কতটা দয়া তা প্রকাশ করার জন্য।আবার ও বলছি,এটি বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়ার গল্প,এমন গল্প বেচে থাকলে পজিটিভ, নেগেটিভ যেভাবেই হোক তৈরি হতে থাকবে,বিচারদিবসের দিন ফাইনালি বোঝা যাবে আদৌ এই অধম দ্বীনে ফিরেছিল কি না।
"নিশ্চয়ই কাফির ছাড়া কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না"(আয়াত নাম্বার টা মনে নেই)
আল্লাহুম্মাগফিরলি, আল্লাহুম্মাগফিরলি,মহান আল্লাহ আমাকে ও আপনাদের বিচারদিবসে মাফ করুন, দ্বীনে অটল থাকার তৌফিক দান করুন।
আমিন
(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোন)
দ্বীনে ফেরার গল্প শেয়ারের আয়োজক
শামছুন্নাহার রুমি




কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.