শিকলে বন্দি ভালোবাসা (পর্ব - ৪, ৫, ৬)

পর্ব: ৫

- মেহজাবিন মুন

আকাশের বুক চিরে উড়ে চলেছে প্লেন। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে জানালার আশেপাশে। নিচের সবকিছু বিন্দুর মতো লাগছে। নায়রার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে আকাশপথে জার্নি। আকাশে পাখির মতো উড়ে চলা, সাদা সাদা মেঘ কেটে সামনে এগুনো, নিচের সবকিছু ছোট হতে হতে বিন্দু বিন্দু হয়ে যাওয়া। সত্যিই নিজেকে তখন একটা মুক্ত বিহঙ্গের মতো লাগে। ইচ্ছা করে জানালা খুলে মেঘগুলো হাত দিয়ে ধরতে। কিন্তু সেটা তো করা যায় না।
ওর পাশে ফারদিন ওর হাত শক্ত করে ধরে আছে, নিজেকে খুব পরিপূর্ণ মনে হয় যখন ফারদিন তার হাত ধরে রাখে। ফারদিন তাকে নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য, ডাক্তাররা বলেছেন এটা তাদের শেষ চেষ্টা। এই দুইমাসের ভিতরে ফারদিন আরও দুই তিনটা দেশে নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য। আগে নায়রা বাবা মায়ের সাথে বিভিন্ন জায়গায় যেত, কি হবে না হবে সে চিন্তা বাবা মা করতেন। কিন্তু এখন নায়রা মনে মনে সবসময় আল্লাহকে ডাকে আর বলে আল্লাহ আমার তাকদিরে থাকলে সবকিছু ঠিক করে দাও। তুমিই তো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।
নায়রা ফারদিনের কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলো,
---আমি যদি ভালো না হই তাহলে কি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
--- এসব বলো কেন নায়রা, আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব। আমরা তো চেষ্টা করতে পারি।
--- আমি জানি একটা মেয়ের জীবনে যেমন মা হওয়া সবচেয়ে আনন্দের, তেমনি একটা ছেলেও চায় সে বাবা হবে। তার ছোট্ট বাবুটা তাকে বাবা বলে ডাকবে, দুষ্টামি আর প্রাণচঞ্চলতায় ভরে উঠবে একটি ঘর। কিন্তু কখনও যদি তা না হয় তাহলে কি তাতে সেই মেয়েটার হাত থাকে? নায়রা ফারদিনের কাঁধে মাথা রেখে কথাগুলো বলছিলো আর চোখবেয়ে অশ্রুকণা পড়ছিল ফারদিনের হাতে। ফারদিন কি বলে শান্তনা দিবে বুঝতে পারলো না। অনেকক্ষণ পর সে নরম গলায় বললো,
--- নায়রা আমি তো তোমাকে দোষারোপ করিনা। যা হয় সব আল্লাহর হুকুমে হয়। আমাদের সবর করতে হবে নায়রা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, "এবং তাদের সবরের প্রতিদানে তাদেরকে দিবেন জান্নাত ও রেশমী পোশাক।" (সূরা দাহর, আয়াত-১২)
তাছাড়া এটাও হতে পারে সন্তান আমাদের জন্য কল্যানকর নয়। সন্তান হয়তো আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে মোহগ্রস্ত করে ফেলতে পারে।
লম্বা একটা লেকচার দেওয়ার পর ফারদিন নায়রাকে ডাক দিলো "তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?"
মনে এরকম ভাবনা আসছিলো ফারদিনের, সত্যিই কি সে যা বললো তা মেনে নিতে পারবে? বাচ্চা নাহলে কি সে নায়রাকে পাশেই রাখবে? ভালোবাসতে পারবে?
কোন সাড়া না পেয়ে তাকিয়ে দেখলো নায়রা তার কাঁধে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারদিন ও সব চিন্তাগুলোকে মন থেকে দূর করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

--- দেখুন উনার যে রোগ সেটা কেন হয়েছে আমরা বুঝতে পারছি না। উনার শরীর ব্লাড আর ডিম্বাণুগুলো ধরে রাখতে পারছে না। এমনকি উনার যে হরমুনাল প্রবলেম সেটাও কেন হচ্ছে আমরা ধরতে পারছি না।
মি. ফারদিন আপনাদেরকে মন শক্ত করতে হবে, আমাদের কিছু করার নেই।
--- কোনভাবেই কি সম্ভব নয়? দেখুন শুধু ওর ব্লিডিংটা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। এভাবে চললে তো ওর..
--- মি. ফারদিন, আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ। উনার শরীরে এমন কোন ধরণের প্রবলেম আছে যা ব্লাড ধরে রাখতে পারেনা। আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে তা সম্ভব হলে তো চিকিৎসা করতামই।
হাসপাতালে শেষবার কথা বলার পর ওরা বেরিয়ে আসলো।
হোটেলে এসেও দুজন কোন কথা বললো না। মাঝরাতে নায়রা তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে সবর, আর কল্যানকর বস্তুই চাইলো। মনে পড়লো,
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, "যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহ তার জন্য যতেষ্ট।" (সূরা তালাক্ব, আয়াত-৩)
সত্যিই তো সন্তান হয়তো আমার জন্য কল্যানকর নয়।কি হবে এসব ধন সম্পদ আর সন্তান দিয়ে যদি কাজে না আসে। আল্লাহ পাক আরও একটা আয়াতে বলেছেন, "হে মুমিনগন! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন না করে, যারা এমন করবে, (উদাসীন হবে) তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা-মুনাফিকুন, আয়াত-৯)
ফারদিন শুয়ে শুয়ে নায়রার সবকিছু দেখছিলো। তার বাবা মা একটা নাতি-নাতনীর জন্য কত আফসোস করছেন। ওদেরকে কি জবাব দেবে? আর নায়রা একেবারেই ভালো হবেনা এটা বাবা মা জানলে কি মনে করবেন। উনারা তো এখনও জানেনই না নায়রা এতবড় একটা রোগে ভুগছে।
নায়রার ডাকে সে ভাবনার জগত থেকে ফিরলো। নায়রার দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখদুটো লাল হয়ে আছে, মুখটাও ফোলা। মেয়েটা রাত থেকে অনেক কেঁদেছে । কিন্তু নায়রা সব দুঃখ ঢেকে রেখে ফারদিনকে হাসিমুখে ডেকে তুললো, চলো ফজরের সময় হয়ে গেছে। আগে ওজু করে আসো।
--- হুমম নামাজ শেষে আমরা আর ঘুমাবো না, নাস্তা করে বাহিরে ঘুরে আসবো। এই ভোরবেলা কেউ থাকবে না, একা তুমি আমি আর প্রকৃতি। সেও জোর করে নায়রার সাথে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো।
দুজন বাহিরে অনেকক্ষণ হাঁটলো, তোষারের মধ্যে কতক্ষণ স্নো বল খেললো। রাস্তায় হটকফি খেলো। সবশেষে গল্প করতে করতে দুজনে হোটেলে ফিরলো।
ফারদিন নায়রাকে তিনমাসের ভিজিট ভিসায় আমেরিকা নিয়ে গেছে। তাই সে ভাবলো নায়রাকে নিয়ে এই তিনমাস খুব ইনজয় করবে, বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে যাবে, আত্মীয়দের বাড়ি যাবে, ওর জন্য অনেক শপিং করবে তারপর দেশে ফিরবে।
নায়রাও সবচিন্তা বাদ দিয়ে দিলো। সে বেশি চিন্তা করলে ফারদিনও মন খারাপ করবে। দুজনই দুজনের সামনে হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু দুজনই ভিতর থেকে দুজনের দুঃখ অনুভব করতে পারে। দুজনই গভীর রাতে বোবাকান্না কাঁদে, একজন না পাওয়ার কান্না, আর অপরজন পেয়ে হারানোর কান্না।
ছয়মাস পর দুজন যখন দেশে ফিরলো তখন মুমুদের পরিবারে অনেককিছু ঘটে গেছে। যা নায়রা কিংবা ফারদিন কেউ জানেনা।

মুমু পাগলের মতো ঘাটাঘাটি করে সব তত্ত্ব বের করলো। আরাফের জন্য একটা খাবারের লিস্ট, একটা বিশ্রামের লিস্ট, চিকিৎসা সবকিছুর চার্ট তৈরি করলো। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় সে বিশ্রাম করতেই হবে। আরাফের প্রতি ভালোবাসা সহানুভুতি যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেলো। এভাবে একমাস অতিবাহিত হওয়ার পর মুমুর আম্মুও হুট করেই আল্লাহর ডাকে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। নায়রাও দেশের বাহিরে, মাও মারা গেছেন। তারপর আরাফের এতবড় অসুখ, মুমু যেন মাঝ নদীতে পড়ে দিশাহারা হয়ে গেলো। দুশ্চিন্তা আর শোকের ঢেউয়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো। কিন্তু মনে একটা মাত্র আশা নিয়েই সে জীবনপথে হাঁটতেই থাকলো। "আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দিবেন" (সূরা তালাক্ব, আয়াত-৭)
"আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা।যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। (আল-ইমরান, আয়াত-১৩৯)
যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহ তার সকল বিপদ দুঃখ দূর করে দেন। এই আশা নিয়েই সে আরাফের সাথে দিন গুজার করতে লাগলো।
অনেক চেষ্টা করে আরাফকে রাজি করিয়ে বাচ্চাদের একটা স্কুলে চাকরি নিলো। যাতে পরবর্তীতে টাকার জন্য আরাফের চিকিৎসার ত্রুটি না হয়। আর কতদিনই বা আরাফ চাকরি করতে পারবে। পরবর্তীতে তো তাদের চলতে হবে। আরাফ দিনদিন ওর এত ব্যাকুলতা আর ভালোবাসা দেখে অবাক হচ্ছে। তাহলে তার একটা মিথ্যা কোন ভুল না, সে মুমুকে সারাজীবন কাছে রাখার জন্য এরকম আরও হাজারটা মিথ্যা বলতে পারবে।
হঠাৎ একদিন মুমুর মনে হলো আরাফ তো তাকে এখনও রিপোর্ট দেখায়নি। ডাক্তারের কাছেও কখনও তাকে নিয়ে যায়নি। অসুখের অবস্থা এখন কোন পজিশনে আছে, কি কি মেনে চলতে হবে সেটাও তো ডাক্তারের কাছ থেকে জানা হলো না।
আরেকটা বিষয় মুমুকে খুব আশ্চর্য করে বিয়ের পর কয়েকমাস হয়ে গেলো আরাফের মধ্যে এইডস এর কোন লক্ষণই দেখলোনা, এমনকি কোন রোগব্যাধিও হলো না আরাফের। তাছাড়া আরাফ ডাক্তারের সাথে বা বোনদের সাথে কথা বললেও আড়ালে গিয়ে কথা বলে। ও তো এতদিন মনে করেছে হয়তো রোগ সম্পর্কে তাকে জানাতে চায়না। কিন্তু এখন কেন জানি আরাফের প্রতি একটা সন্দেহ দৃঢ় হতে লাগলো। আজ আরাফ অফিস থেকে আসলে তাকে জিজ্ঞেস করেই ছাড়বে।
বাগানে বসে পায়রাদের খাবার খাওয়াচ্ছিলো আর এসবই ভাবছিলো মুমু। আরাফের বাগান করার খুব শখ, মুমুরও ভালো লাগে তাই আগে থেকে করে রাখা বাগানে আরাফ মুমুর পছন্দের ফুল এনে লাগিয়েছে। বাংলোতে কাজের লোক থাকা সত্বেও মুমু আর আরাফ দুজনেই নিজহাতে বাগানের পরিচর্যা করে, পায়রা পালে। এদের খাবার খাওয়ানো, রোগব্যাধি সবকিছু তারাই দেখাশোনা করে।

--- আসসালামু আলাইকুম, রানী সাহেবা দেখি কাজে ব্যস্ত।
--- হুম্ম, বসে বসে অনেক কিছু চিন্তা করছিলাম।
--- কি হয়েছে? কোন বিষয়ে আমার উপর রেগে আছো? নাকি সন্দেহ?
মুমু সালাম না দিলে কিংবা সালামের জবাব বা দিলে আরাফ বুঝে যায় মুমু তার উপর রাগ করেছে।
--- নাহ্ কিছুনা, তোমাকে ক্লান্ত লাগছে, ঘরে চলো।
--- তাহলে সালামের জবাব দিলেনা যে? ওয়াজিব কি কেউ ইচ্ছাকৃত তরক করে? আমার জামাও খুলে দিলেনা যে? মুমুর পিছু পিছু আরাফ আসতে আসতে কথাগুলো বললো।
--- সালামের জবাব আমি মনে মনে দিয়েছি। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, খেতে খেতে কথা বলবো। আমি ভাত বাড়ছি।

আরাফ ভয়ে ভয়ে এসে খাবার টেবিলে বসলো, ওর মিথ্যাগুলা কি ধরা পড়ে গেছে? কিভাবে পড়বে ও তো তেমন কিছু বলেনি, কিংবা এরকম কিছু করেওনি।
টেবিলে তার পছন্দের পুঁইচিংড়ি, শিংমাছের ঝুল, সবজি, ভর্তা, গোশত ভুনা।
--- এত্তকিছু তুমি বানিয়েছো? ওয়াও আমার বউ তো দারুণ রাধুনি, আগে খেয়ে নিই চলো।
--- যত যাই করো বাঁচতে পারবে না। সত্যি করো বলো তোমার অসুখের রিপোর্ট কোথায়? প্রেসক্রিপশন কোথায়? ঔষধ আমাকে না দেখিয়ে নিজে নিজে খাও কেন?
--- মুমু আমি আগেই তোমাকে বলেছি ডাক্তার ঔষধ সব আমি একা করবো। বাকি সেবাযত্ন, খাবার দাবার সব তুমি। তুমি কি চাও আমি এখনই বিছানায় পড়ি?
--- আমি এটা চাইনা, আমি শুধু একবার তোমার রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন দেখতে চাই।
--- আ-আচ্ছা পরে দেখাবো, ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাবো। ঠিকাছে? এখন খেতে দাও প্লিজ।
সাথে সাথে মুমুর রাগ পড়ে গেলো, সে আরাফের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলো। দুজন একসাথে বসে গল্প করতে করতে খাবার শেষ করলো।
খাবার শেষে আরাফ বললো, তোমার রাগ একটুতেই নেমে যায় বলেই তোমাকে এত ভালোবাসি।
--- জি না জনাব, শুধু তোমার উপর রাগ করে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা।

রাতে আরাফ ডাক্তারের সাথে কথা বলার সময় আড়াল থেকে মুমু সবকিছু শুনে ফেললো। ও এত্তবড় মিথ্যা শুনে নিজেকে সামলাতে পারলো না। এটা শুনে মুমু খুশি হবে, না এতবড় কথা লুকানোর জন্য, এতবড় ত্যাগ এর জন্য আরাফকে জড়িয়ে ধরবে বুঝতে পারছে না। নাহ এ হতে পারে না, মিথ্যা বলা মহাপাপ। আর এটা যদি হয়....
.

(৫ম পর্ব)

-
আজই মুমু এক জায়গায় চাকরি অফার পেয়েছিলো। অনেকদূরে চাকরির স্থান থাকায় ভেবেছিলো চাকরি করবে না, কারণ তখন আরাফের খেয়াল রাখাটা কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর চাকরি ছাড়তে সে রাজি না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ঘরে ঢুকলো। তারপর না চাইতেও আচমকা কিছু ঘটনা ঘটে গেলো। মুমু দৌড়ে গিয়ে আরাফকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করলো। আরাফের কষ্ট হলেও বাধা দিলো না, সে ভাবলো আরাফের অসুখের কথা ভেবেই মুমু কাঁদছে, আজকাল যখন তখন মুমু কাঁদে। আরাফ জানেনা এরকম মিথ্যা বলে কতদিন মুমুকে আটকে রাখবে।
--- আই এম স্যরি, আসলে মাঝে মাঝে আমার কি হয়ে যায় বুঝিনা। অতি দুঃখে কাঁদি, অতি সুখেও কাঁদি।
--- চিন্তা করো না মুমু, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
--- একদিন...! হ্যা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

সকালবেলা মুমু রান্নাঘরে চলে গেলে আরাফ বড়বোন ফাহমির সাথে ফোনে কথা বলছিলো।
---তুমি বুঝতে পারছো না আপু, এখন বললে মুমু কি পরিমান রাগ করবে। আমি চাইনা ও আমাকে ছেড়ে চলে যাক।
--- (....)
--- কি হবে আরেকটা বিয়ে করে? আমি ওকে নিয়েই সুখি, বিয়ে মানে তো শুধু শারিরীক সম্পর্ক নয়, বিয়ে মানে দুটি মনের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, সুখ-দুঃখ শেয়ারের মানুষ, আপনজন। দিনশেষে শান্তির নিঃশ্বাস নেওয়া যায় যার কাছে, যার হাত ধরে পাড়ি দেওয়া যায় পুরোটা জীবন পথ। আমার এমনই একজন সঙ্গী হচ্ছে মুমু। আল্লাহ আমাদের তাকদিরে সন্তান রাখেননি আপু। সব চাওয়া তো একজীবনে পূর্ণ হবার নয়।
--- (.....)
--- আপু তুমি চিন্তা করে দেখো মুমু মেয়েটা কেমন। অন্যকোন মেয়ে এতবড় রোগের কথা শুনলে সেদিনই চলে যেতো। জীবনে মুমুর মতো এত রিস্ক নেওয়ার কথা ভাবতোই না। ও আমার জন্য দিনরাত আল্লাহর কাছে কাঁদছে। সেবাযত্ন আর আমাকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নিজে চাকরি খুঁজছে যাতে পরবর্তীতে আমার চিকিৎসায় কোন প্রবলেম না হয়। এমনকি সে কথাগুলো কাউকে কিছু বলেও নি।
---(...)
--- এতবড় মিথ্যা বলায় আমারও কষ্ট আর অনুশোচনা হচ্ছে আপু। কিন্তু ওকে হারালে যে তারচেয়ে বেশি কষ্ট হবে। ওকে ছাড়া আমি নিঃশ্ব হয়ে যাবো। আমার সন্তান চাইনা আপু।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এপাশের কথা শুনলেও ফোনের ওপাশের কথাগুলো মুমু শুনতে পেলো না।
কেন জানি দুইদিন থেকে আড়িপাতা ওর স্বভাব হয়ে গেছে। ও এখনও আরাফকে বুঝতেই দেয়নি ও যে জেনে ফেলেছে আরাফের এইডস হয়নি। এমনকি কেন রোগই হয়নি। তাই ওকে বিব্রত অবস্থায় না ফেলতে পরদিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জিদ ধরেনি।
কিন্তু দুইদিন থেকে তার খুব চিন্তা আর মন খারাপ হয়ে আছে।
সূর্য ডুবে গেছে, পাহাড়ের ওপারে হারিয়ে গেছে লাল হলুদ সূর্যটা। সবুজ বৃক্ষের মাথায় কাঁপন ধরিয়ে বয়ে গেলো একঝলক বাতাস। মর্মর ধ্বনিতে মাটিতে গড়ালো কয়েকটা শুকনো পাতা। এই পাহাড়ি এলাকায় একটু আগেই যেন সূর্যটা অস্ত যায়, রাতটা ঘনিয়ে আসে একটু তাড়াতাড়িই।
জানালায় এতক্ষণ থেকে মুমু দাঁড়িয়ে ভাবনার জগতে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে।
আল্লাহু আকবার...
সূমধুর সূরের আহবান ভেসে এলো মসজিদ থেকে। ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো, আজ যেন বুক ফেঁটে কান্না আসছে তার। হারিয়ে কোনকিছু পাওয়ার কান্না, অপরিসীম ভালোবাসা পাওয়ার কান্না। আরাফের মতো একজন সঙ্গী পাওয়ার কান্না।
নামাজ শেষে দীর্ঘ মুনাজাতে নিজের ধৈর্য্য আর আরাফের সুস্থতা কামনা করলো। বসে বসে সূরা ওয়াকিয়া তিলাওয়াত করছিলো তখন পিছন থেকে আরাফ ওর পাশে বসলো। ও যতক্ষণ তিলাওয়াত করলো ততক্ষণ আরাফ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তিলাওয়াত শেষে মুমু জিজ্ঞেস করলো, এভাবে তাকানোর কারণ কি জনাব?
--- আমি আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছি এটা হচ্ছে সওয়াবের কাজ।
---বাব্বাহ! এত সওয়াবের আমার দরকার নেই। তুমি বসো আমি চা নাস্তা নিয়ে আসছি।
মুমু উঠে যেতে চাইলে আরাফ ওর হাত ধরে ফেললো। তারপর বললো,রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "স্বামী স্ত্রী যখন একে অপরের দিকে রহমত ও মহব্বতের দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকায় তখন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালাও তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি বর্ষণ করেন" (বুখারী-৬১৯, তিরমিজি ১৪৭৯)
এখন তুমি আমার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। যাতে আমার সমান সওয়াব হয়, কমবেশি হলে জান্নাতে একজন আগে একজন পরে যাবো। এই সময়টাও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
--- আরাফ, এখনও বাচ্চামো করার সময় নয়। এখন তুমি বাবা হবে, দায়িত্ব বাড়বে তাই এই বয়সে এতটা আবেগী হওয়া ঠিক নয়। যদি কোন কারণে তুমি আমি আলাদা হয়ে যাই, কিংবা মারা যাই তখন কিভাবে থাকবে বলো?
--- আমরা আলাদা কেন হবো? তুমি যেখানে যাবে আমি তোমার পিছু পিছু যাবো। বাবা হওয়া লাগবে না আমার।
--- আচ্ছা ঠিক আছে, তবে একটা কথা আগামী দুইদিন সময় তুমি শুধু আমাকে দেবে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নাও, আর আমি ততক্ষণে চা বানিয়ে আনছি।
--- কি ব্যাপার মহারানী? কোন গোপন ষড়যন্ত্র চলছে নাকি?
--- রাতে চাঁদ দেখতে দেখতে বলবো। "এই রাত তোমার আমার" একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা বলে মুমু চলে গেলো।
এই দুইদিন মুমু আরাফকে একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিলোনা, সারাদিন গল্প, সাজগোজ করে ঘরের ভিতর পিকনিক করা, একজন অপরজনের কোলে মাথা রেখে গল্প শুনানো, তিলাওয়াত শুনানো। রাতে ছাদে বসে চাঁদ দেখা, তারা গুনা। আর মাঝরাতে ছাদেই জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পড়া, তাহাজ্জুদ আর ফজরের পর খালিপায়ে পাহাড়ী বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। সব ধরনের ভালোবাসা, মাস্তি চললো তাদের দুজনের মধ্যে। এর ভিতরেই মুমু চাকরিটা কনফার্ম করে নিয়েছে। ও যে মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরাফ বা অন্য কেউ তা বুঝতেই পারলো না।
সেদিন আরাফ অফিসে চলে যাবার পর মুমু ওর শার্ট হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো। তারপর চিঠি লিখতে বসলো।

"সালাম,
পত্রের শুরুতেই ভণিতা না করে বলতে চাই তুমি যে মিথ্যা বলেছো তা আমি জেনে ফেলেছি। মিথ্যাটা তো তুমি আমার জন্যই বলেছো। তোমার সামনে কথাটা বললাম না কারণ তুমি তখন লজ্জা পেতে, লজ্জা তো আমার পাওয়া উচিত কতটা স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমার সুন্দর একটা জীবন, ভবিষ্যৎ আছে, তা আমার পিছনে কেন নষ্ট করবে? আমি জানি প্রত্যেকটা মানুষই চায় তার সন্তান হোক, ঘরটা আনন্দে ভরে উঠোক। আমিও চাই তোমার বংশ বৃদ্ধি পাক। আর তা আমার সাথে থাকলে কখনও হওয়ার নয় আরাফ। আমি জানি অনেক বড় মনের মানুষ তুমি, তাইবলে এতবড় হওয়া ঠিক নয় আরাফ। আমার জন্য তুমি অনেক করেছো, ঘরের সবাইকেও আমার অজান্তে বুঝিয়ে ঠিক করেছো। তারপরও সবারই একটা আশা থাকে। তুমি আপুদের একমাত্র ভাই, তুমি তাদের আশায় গুড়ে বালি করোনা। তুমি আরেকটা বিয়ে করো, সংসার করো। আমিও চাই তোমার অনেক সন্তান হোক, আনন্দে আর হৈ হুল্লোড়ে ভরে উঠোক এ আঙ্গিনা। তাই আমি তোমার কাছ থেকে অনেকদূরে চলে গেলাম। যেখানেই থাকবো তোমার কথা ভেবে তোমাকে ভালোবেসে ভালো থাকবো। তুমিও অনেক অনেক সুখী হও এই দু'আ আমার প্রতিটা মোনাজাতে থাকবে।

আল্লাহ হাফেজ"
বিকালবেলা অনেক ভেবেচিন্তে আরাফ ঘরে ফিরলো। "নাহ এই মিথ্যার বুঝা আর বয়ে নেয়া যাচ্ছে না। আজই মুমুকে বলে ক্ষমা চেয়ে নিবো, আর তাওবা করে আল্লাহর কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিবো।"
সে ঘরে ফিরে সে সব জায়গা খুঁজলো কোথাও মুমুকে পাওয়া গেলো না। বাগানে, কাছের পাহাড়ে, লেকের পারে কোথাও মুমুর কোন দেখা নেই। চিন্তিত মনে আবার বেডরুমে ঢুকে দেখলো একটা গিফট বক্স দিয়ে একটুকরো কাগজ চাপা দেওয়া। দৌড়ে গিয়ে কাগজটা হাতে নিলো, এক নিঃশ্বাসে পড়া শেষ করে সেখানেই বসে পড়লো।
"মুমু সব জানতো আর আমাকে কিছু বুঝতেই দেয়নি! ওর মনে এতবড় আঘাত দেওয়ার পরেও সে একবারও জিজ্ঞেস করে নি লজ্জা পাবো বলে। ইয়া আল্লাহ! আমি এখন ওকে কোথায় খুঁজবো? আমার সুখের জন্য সে এতবড় ত্যাগ স্বীকার করলো। এজন্যই আমি বলতে চাইনি। আরাফ তার বোনদেরকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলো। উনাদের এক্ষুণি আসতে বলে সে মুমুদের বাড়ি গেলো সেখানে আছে কিনা খুঁজতে। কিন্তু না.. বান্ধবী, আত্মীয় স্বজন কারও বাড়িতেই মুমুকে পাওয়া গেলো না। আরাফ মুমুর জন্য পাগলের মতো আচরণ শুরু করলো। আরাফের বোনেরা তাকে বুঝালো মুমুর রাগ কমে গেলে সে এমনিতেই চলে আসবে৷ মুমু যে আরাফের উপর রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতেই পারেনা।
আরাফও এই আশা নিয়ে পথচেয়ে বসে থাকলো। কিন্তু দিন যায়, মাস যায় মুমু আর ফিরে আসেনা। মুমুর দেওয়া গিফট ও আরাফ খুলে দেখলো না। শেষ স্মৃতি মনে করে রেখে দিলো তার প্রিয় কিছু জিনিসের মাঝে।

দেশে আসার পর ফারদিন নায়রাকে নিয়ে তার কেনা নতুন বাসায় উঠলো। এই তিনটা মাস অনেক ভাবনা চিন্তা করে, সবার সাথে আলোচনা করে সে একটা সিদ্ধান্তে এসেছে। অবশ্য নায়রাকে এসব এখনও জানতে দেয়নি। আগে থেকে মেয়েটাকে এসব বলা ঠিক হবেনা। এমনিতেই সারাজীবন মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এটা ভাবলে তো জীবন চলবে না। জীবন যে বহমান স্রোতের মতো বয়েই চলেছে। কোথাও রাস্তা না পেলে বাঁধভাঙা নদীর মতো সে নতুন রাস্তা বানিয়ে নেয়, আবার পলির উর্বরতায়, সবুজে শ্যামলে ভরে উঠে নদীর তীর। খরস্রোতা নদীর বুক ভরে উঠে নানারকম মৎস প্রজাতিতে। আর তা থেকে জিকা নির্বাহ করে মানুষ৷ একদিকে নদী ধ্বংস করলেও অন্যদিকে গড়ে তুলপ নতুন বসতি। আর সে প্রতিদান না নিয়েই সাগরের পানে ছুটে চলে অবিরাম। সেভাবেই থেমে না থেকে আমাদেরও নদীর মতো এগিয়ে যেতে হবে। চলার পথে নতুন নতুন রাস্তা সৃষ্টি করতে হবে শত বাধা বিপত্তি আসলেও। তাকে ভুল বুঝলেও একসময় নায়রা বুঝবে এটা জরুরি ছিলো সবার জন্য।
আর এক সপ্তাহ পর ফারদিন আমেরিকা চলে যাবে। নায়রা রুমে মন খারাপ করে বসে আছে। নিচে মেহমানরা সবাই বসে গল্প করছেন। ফারদিন কয়েকদিন থেকে শুধু ব্যস্ত থাকে, কিসের এত ব্যস্ততা জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলে না। একবারও ভাবেনা ফারদিন চলে গেলে নায়রা কেমন করে একা থাকবে। তারও তো ইচ্ছা করে এসবকিছু ফারদিনের সাথে বসে শেয়ার করতে। কিন্তু নায়রা ঠিকই বুঝতে পারছে ব্যস্ততার নামে ফারদিন তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। হয়তো তার অসুস্থতার জন্য, এই অসুখের সাথে মনটাও যদি রক্তক্ষরণে ভোঁতা হয়ে যেত। তাহলে মনের ভিতরের এই ভালোবাসা শিকলে বন্দি থাকার মতো যন্ত্রণায় ছটফট করতো না।
এতকিছুর পরেও নায়রা সবার সাথেই স্বাভাবিক আচরণ করছে, সবার মেহমানদারী করছে।
ফারদিন যাওয়ার আগের দিন নায়রাকে জীবন সম্পর্কে অনেককিছুই বুঝালো। তারপর বললো,
-- নায়রা আমি চলে যাওয়ার পর তুমি এই ড্রয়ারটা খুলবে।
--- কেন এখানে কি রাখা? কোন গিফট? এখন খুলে দেখলে কি হয়?
--- না নায়রা এখন খুললে তো সারপ্রাইজ শেষ হয়ে যাবে। এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সারপ্রাইজ। আমি ওখানে পৌছে তোমায় ফোন করার পর তুমি এটা খুলবে।
--- তুমি যখন বলছো তখন পরেই নাহয় খুলবো। আচ্ছা বিদেশে গিয়ে তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে?
--- নায়রা এখন এসব কথা বলার সময় নয়, ফজরের সময় উঠতে হবে। চলো ঘুমিয়ে পড়ি।
--- হুমম চলো, আমিও কি বোকা। কোন স্বামী কি তার স্ত্রীকে ভুলতে পারে?
ইদানীং নায়রা ফারদিনকে ছাড়া কিছুই বুঝে না, চেষ্টা করে নিজেকে সংযত রাখতে কিন্তু পারে না। তার জন্য ফারদিন এতকিছু করছে না চাইতেই মনের গভীর থেকে ভালোবাসা উতলে উঠে। সারারাত নায়রা চোখের পানি ফেললো, ফারদিন চলে যাওয়ার কষ্টে। কেন জানি মনে হয় সে ফারদিনকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে।

ফারদিন ফোন করে বলার পর নায়রা ড্রয়ার খুললো। তার জন্য যে এতবড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করবে তা ভাবতেও পারেনি। নাহ এ হতে পারে না। এ কিভাবে সম্ভব? তার স্বামী এটা করতে পারেনা।
ইয়া আল্লাহ! এখন আমি কি করবো? নায়রা সেখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে গেলো।

To be continue In sha Allah



(৬ষ্ট পর্ব)

-মেহজাবিন মুন

অনেকক্ষণ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে নায়রার মা নায়রাকে ডাকতে ডাকতে উপরে উঠে আসলেন। নায়রাকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে তিনি "নায়রা" বলে চিৎকার দিয়ে ওকে এসে ধরলেন। নায়রার হাতে একটা কাগজ দেখে উনি সেটা হাতে নিয়ে দেখেই 'থ' হয়ে বসে রইলেন। উনার চিৎকারে নিচতলা থেকে বাকি মেহমানরাও উঠে আসলো। নায়রার বোন সারাহ আর ফারদিনের বোনেরাও এসে ওকে নিচে থেকে বিছানায় তুলে চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরালো। নায়রার মা তখনও কাগজ হাতে নিয়ে সেখানেই বসে রইলেন।
নায়রার বোন সারাহ এতক্ষণ পর বিষয়টা খেয়াল করলো।
--- কি ব্যাপার আম্মু? তুমি ওখানে বসে রয়েছো কেন?
উনার কোন সাড়া না পেয়ে সারাহ উঠে এসে উনার পাশে বসলো।
--- তোমার হাতে এটা কি আম্মু? ডিভোর্স পেপার? এটা তো দেখছি ফারদিনের... আর কিছু না বলেই সারাহ মায়ের দিকে তাকালো। উনার চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে পানি পড়ছে।
নায়রা বিছানায় উঠে বসে কয়েকবার ফারদিনের ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু তার ফোন বন্ধ। অথচ কয়েক মিনিট আগেও ফারদিন তাকে ফোন করে ড্রয়ার খুলার কথা বলেছে। একটু সময় ঝিম মেরে বসে থাকলো। তারপর সারাহ কে ডাক দিলো,
-- আপু আমাকে একগ্লাস পানি দাও তো।
একেবারে স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বললো নায়রা। সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো ভাবলো নায়রা মনে হয় পাগল হয়ে গেছে।
--- কি হলো আপু? কাগজটা এদিকে আনো আর একগ্লাস পানি দাও। ওহ্ ভাবছো পাগল হয়ে গেছি পরে বলছি আগে পানি.. কথা শেষ করার আগে ফারদিনের বোন ওকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।
পানি খেয়ে কাগজটা সে হাতে নিলো, কাঁপা কাঁপা হাতে সাক্ষর করে দিলো তার নামের জায়গায়। তারপর বললো কিছুক্ষণের জন্য স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আল্লাহ যা করেন তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন।
একটা হাদিস বলি শুনো, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "মুমিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক! তার প্রতিটা অবস্থাই তার জন্য কল্যান বয়ে আনে। আর এটা কেবল মুমিনের জন্যই নির্ধারিত, অন্য কারো জন্য নয়। মুমিনের কাছে সুখের কিছু এলে শুকরিয়া আদায় করে। এটা তার জন্য মঙ্গলময় হয়। অনুরূপভাবে যখন কোন দুঃখ তাকে স্পর্শ করে, তখন সে ধৈর্যধারন করে। আর এটাও তার জন্য মঙ্গলময় হয়।"
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৯৯৯)
অতএব কোন হতাশা, কোন দুঃখ নয়। তারপর ফারদিনের বোনদের দিকে ফিরে বললো, --আপুরা সম্পর্ক কখনও শেষ হয়না ,শুরু হয়। আপনারা সবসময় আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবেন, আত্মীয়তাও থাকবে। ওখানে একটা চিঠিও আছে দেখেছি পড়ে শুনাই সবাইকে।
"নায়রা"
এই চিঠি যখন পড়বে তখন আমি মোবাইল বন্ধ করে তোমার সাথে চিরতরে সব যোগাযোগ শেষ করে দেবো। আমি চাইনা যে সম্পর্ক শেষ হবে সেটা আবার নতুন করে শুরু হোক। এটা এমন একটা সম্পর্ক যেটাতে সবসময় একটা কষ্ট, একটা চাপ, মানসিক অশান্তি আর কিছু অব্যক্ত বেদনা থাকবে। আমি কিংবা তুমি নিশ্চয় এরকম সম্পর্ক আশা করিনা? তাই অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। আমি তোমার হক্ব নষ্ট করিনি। এই বাড়িটা আমি তোমার নামেই কিনেছি, ব্যাংকেও প্রায় বিশ লাখের মতো টাকাও তোমাকে দিয়ে গেলাম যাতে তোমাকে কখনও টাকা কিংবা থাকার জায়গা নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। এখান থেকেই তুমি তোমার চিকিৎসা করিয়ে যেও, আমি মাঝে মাঝেই তোমার একাউন্টে টাকা পাঠাবো। চেকবই আর দলিলপত্র তোমার হক্ব বা মুহরানা মনে করে গ্রহণ করিও। আর কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনা।
"ফারদিন"
সকালবেলা সবাই যার যার বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তখনই এ ধাক্কা, তারচেয়ে বড় ধাক্কা খেলো ফারদিনের বোনেরা, তারা নায়রাকে শান্তনা দেবে কি রাগে জ্বলে উঠলো। দুইদিন হয়নি ভাই বিয়ে করেছে এর ভিতরেই এতটাকার বাড়ি, চেক নায়রার নামে লিখে দিয়েছে। ডিভোর্স দিয়েছে ভালো হয়েছে নাহলে আরও কত কিছু দিতো। উনারা ডিভোর্স দেওয়ার কারনও জানতেন, ভাইয়ের কথামতো এখানে ছিলেনও নায়রার রিয়েকশন কি হয় দেখার জন্য। যাতে পরবর্তীতে ফারদিনকে জানাতে পারেন। কিন্তু ভাই যে উনাদেরও না জানিয়ে এতকিছু নায়রার নামে দিয়ে দিবে কল্পনা করেননি। ওকে শান্তনা দেওয়ার জন্য কতকিছু মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন এখন আর কিছুই বললেন। চুপচাপ দুজনই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আর নায়রার মা ওর পাশে হাত ধরে বসে থাকলেন।
--- আম্মু তুমি ভেবো না আমি ভেঙ্গে পড়বো। এটা আল্লাহর হুকুমই ছিলো, তাকদিরের লিখন তো কেউ খন্ডাতে পারেনা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, "এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুদা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।"
(সূরা বাক্বারা: ১৫৫)
আমি বুঝতে পারছিলাম ফারদিন মনে মনে খিচুড়ি পাকাচ্ছে, তবে এটা করবে ভাবিনি আম্মু।
--- এসব চিন্তা বাদ দে নায়রা। তবে তোর ডিভোর্স পেপারে সাইন করা উচিত হয়নি। সারাহ ওদের বিদায় দিয়ে এসে নায়রার কথাগুলো শুনে উত্তর দিলো।
--- না আপু, যত যাই করি যে চলে যাওয়ার সে তো যাবেই। আর জোর করে কোন সম্পর্ক হয়না, কোন কারণে সে আমাকে সাথে রাখবে? না হবে বাচ্চা, না আমি কোনদিন সুস্থ হবো। ও তো আমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেছে। আমারও উচিত ওর সিদ্ধান্ত কে সম্মান করা।
নায়রার বিষয়টা বাতাসের আগে সবার কাছে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই বলাবলি করলো নিশ্চয় নায়রা ফারদিনের সাথে কোনকিছু করেছে, কিংবা অতীত কন ঘটনা আছে। আজকাল বোরকাওয়ালী মেয়েরাই বেশি খারাপ কাজ করে। যে কারণে ফারদিন তাকে তালাক দিয়েছে। বাড়ির সবাই সহ নায়রা সম্পূর্ণ চুপ হয়ে গেছে, কার কথার জবাব দেবে সে। কি জবাব দেবে? সে যে জবাববিহীন এক তামাশার পুতুল হয়ে গেছে। আজ পনের দিন হয়ে গেলো ফারদিন চলে গেছে। এর মধ্যে একটি বারও একটা মেসেজ করেনি, ফোন তো দূর। এত প্রেসারের মধ্যে নায়রা খেয়ালই করেনি এই কয়দিন তার প্যাড পরা লাগেনি। আজকাল মাথা শুধু ঘুরে, বমি ভাব ও করে, খেতেও ইচ্ছা করেনা। সে ভাবলো হয়তো অতিরিক্ত চিন্তায় এমন হচ্ছে। এতবড় বাড়িতে সে তার মায়ের সাথে একা একা আছে। সবাই বলেছে বাবার বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য, কিন্তু নায়রার কেন জানি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করেনা।
--- কি রে এখানে বসে কি করছিস? ওমা তুই এত তেতুল কোথা থেকে এনেছিস? ইয়া আল্লাহ! ব্লিডিং তো আরও বেড়ে যাবে এত টক খেলে।
--- জানিনা আম্মু টক খেতেই ভালো লাগছে। ও আম্মু তোমাকে বলা হয়নি আমার পিরিয়ড একটু কমেছে, মনে হয় ঔষধে কাজ হচ্ছে।
--- তুই ঔষধ খাচ্ছিস তো ঠিকমতো?
--- আরে আম্মু এই পনেরো দিন তো আমি কোন ঔষধই খাইনি তবে কমলো কিভাবে? নায়রা অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো।
--- কি জানি বাবা তোর আরও কত কি। চল ভাত খাবি, এই ভর দুপুরবেলা ভাত খাওয়া ছেড়ে কেউ তেতুল খায়?
নায়রাকে নিয়ে হাঁটতে হাটঁতে বকবক করতে লাগলেন নায়রার মা। কিন্তু খেতে বসে নায়রা এমন বমি শুরু করলো যে উনি ভয় পেয়ে গেলেন। ছোটবেলা থেকে নায়রা বমি করতে প্রচুর ভয় পায়, এমনকি ওর কখনও বমি হয়ও না।
লক্ষণগুলো যেন অন্যরকম লাগছে। উনি সেদিনই নায়রাকে জোর করে উনাদের পূর্ব পরিচিত মহিলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি বিভিন্ন চেকআপ করে জানালেন নায়রা মা হতে চলেছে।
--- খালা আপনি তো আমার সব কথাই জানেন। বিদেশের ডাক্তাররাও না করে দিয়েছে আমার কখনও বাচ্চা হবেনা। এমনকি পিরিয়ড ও বন্ধ হবেনা।
--- জি আপা এটা তো জানেন তাহলে কিভাবে এসব সম্ভব এসব? ওর মা ও জিজ্ঞেস করলেন।
--- সব আল্লাহর হুকুম বোন। আমি রিপোর্ট গুলো কয়েকবার করে চেক করেছি। আমি নায়রাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই আপনি একটু বাহিরে গিয়ে বসুন।
নায়রার মা বাহিরে আসার পর ডাক্তার ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে তারপর বললেন,
---আমি কনফার্ম তুমি প্র্যাগনেন্ট। বাকিটা আল্লাহ জানেন, কিছু ঔষধ আর নিয়ম লিখে দিচ্ছি ঠিকমতো মেনে চলবে।
নায়রা এতটা অবাক হলো যে ও কথা হারিয়ে ফেললো। আল্লাহ তাকে এতবড় নিয়ামত দান করছেন, তাহলে আল্লাহর পরীক্ষায় কি সে পাশ হয়ে গেলো? এত তাড়াতাড়ি?
--- "নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি" (সূরা ইনশিরাহ: ৬) এই আয়াতটা কি ভুলে গেছো নায়রা?
ওর অবাক হওয়া দেখে ডাক্তার তাকে আয়াতটি শুনালেন।
নায়রা জানে এই ডাক্তার অনেক ধার্মিক, তিনি সম্পূর্ণ পর্দা মেনেই সবার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই সেও উনাকে খুব সম্মান করে। নায়রা তাও কথা বলছে না দেখে তিনি উঠে এসে নায়রার কাঁধে হাত রাখলেন। আর নায়রা উনাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আজকের কান্না যে অনেক কিছু হারিয়ে সবচেয়ে মূল্যবান কিছু পাওয়ার কান্না। আজকের কান্না সবচেয়ে বেশি খুশির কান্না। ওর কান্না শুনে নায়রার মা ও চেম্বারের ভিতরে এসে কনফার্ম রিপোর্ট শুনে মেয়ের খুশিতে তিনিও কেঁদে ফেললেন। "মেয়ে আমার সারাজীবন কষ্ট করেছে, কষ্ট পেয়েছে। ওর মতো কষ্ট হয়তো আর কেউ কখনও পায়নি। আল্লাহ তোমার লাখো কোটি শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ!"
মায়ের কথা শুনে নায়রা সংবিৎ ফিরে পেলো। নাহ্ তাকে এখন কাঁদলে হবেনা। এখন অনেক কাজ করতে হবে তার।

বাড়িতে ফিরে আসার পর নায়রা ভাবলো মুমুর সাথে একবার কথা বলতে হবে। এতদিন হয়ে গেলো মুমু তার সাথে একবারও যোগাযোগ করলো না। সেও মুমুকে একটা ফোন দিলোনা। আশ্চর্য মানুষ সংসার জীবনে ঢুকে গেলে কি এমন করেই তার প্রাণের বান্ধবীকে ভুলে যায়? সেও বা কিভাবে ভুলে গেলো ভেবে অবাক হলো। সাথে সাথে মুমুকে ফোন দিলো, নাম্বার বন্ধ দেখাতেই মুমুর আম্মুকে ফোন দিলো সেটাও বন্ধ। অবাক হওয়ার সাথে সাথে চিন্তাও বাড়লো তার। রান্নাঘরে আম্মুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো তিনি মুমুর কথা জানেন কিনা? ওর আম্মুর কিছু হয়েছে কিনা?
--- ওহ্ তোকে এতকিছুর মধ্যে বলার সুযোগই হয়নি। মুমুর আম্মু তোরা বাহিরে যখন ছিলি তখনই মারা গেছেন। আর কি এক অজানা কারণে মুমুও কোথায় জানি চলে গেছে। ওর স্বামী তো ওকে খুঁজতে খুঁজত পাগল। আমাদের বাড়িতেও এসেছিলো খুঁজতে।
-- ইন্না-লিল্লাহ! এসব কি বলছো আম্মু? এতকিছু হলো আর ও আমাকে কেন ফোন দিলো না, কিছু বললও না।
--- ও হ্যা ও তোর জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছে। বলেছে শুধুু তুই যেন পড়িস। আমার ব্যাগেই আছে।
--- কোথায় ব্যাগ? এক্ষুনি দাও আমি দেখবো।

ছোট্ট একটা চিরকুটে লেখা,
"সখী আমি বগুড়ায় আছি। (....) ঠিকানায় চলে আসিস অনেক কথা আছে তোকে বলার জন্য আমি অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে আছি। আশা করি কাউকেই জানাবি না, এমনকি আরাফকেও না।"
নায়রা চিরকুট পড়ে চিন্তায় পড়ে গেলো। আরাফের সাথে কি মুমুর ঝগড়া হয়েছে? এমন তো হওয়ার কথা না।
--- আম্মু তুমি এটা পড়েছো?
--- না, মুমু আমাকে ওয়াদা করিয়েছে না পড়তে এমনকি কাউকে না বলতে। তাই পড়াও হয়নি, কাউকে বলাও হয়নি।
--- শুকরিয়া। আমি আগামীকালই মুমুর কাছে চলে যাবো।
--- ও কোথায়? আর তুই এই অবস্থায় কোথায় যাবি?
--- আম্মু এই মুহুর্তে মুমুকে আমার আর ওর জন্য আমাকে বেশি প্রয়োজন। তুমি না করিও না, যা হয় আমি যাবোই।

To be continue in sha Allah.






কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.