গল্প: তোমায় নিয়ে পর্ব: ১৬+১৭


গল্প: তোমায় নিয়ে
লেখাঃ সানজিদা সুরাইয়া স্মৃতি

পর্ব: ১৬+১৭



নীরা একাধারে শাশুড়ির কথা গুলো শুনছে। ভাবছে, মা এত হাদিস জানে? মা যেমন ঠিক তার ছেলেও হয়েছে তেমন।
আসলেই তো মা রত্নগর্ভা! এমন একটা ছেলেকে জন্ম দিয়েছে।
- নীরা!
- জি মা?
- ওই তেলের কৌটাটা দাও তো।
- এই নিন। কি এমন আছে এই তেল এ?
- আমলকী থেতো করে শুকিয়েছিলাম। সেটাই তেলের মধ্যে চুবিয়ে রেখেছি। আলহামদুলিল্লাহ! চুল পড়া কমে। এখন থেকে এইটা দিবা।
- নীরা হাসে!
- চুলে তেল দিবা এমন উসকো খুসকো চুলে যেন না থাকে।
- নীরা ভেবেছিল সব শাশুড়ি এক। আসলে নীরার ভুলটা ভেঙে গেছে। নীরা ঈশামের কথা ভাবছে। আসলেই এমন একটা ছেলেকে সে জীবনসংগি হিসেবে পাবে তা চিন্তাতেও আসে নি। কিন্তু নীরাই বা ঈশামকে এত দূরে রেখেছে কেন?
তাকে কেন স্ত্রীর হক দিচ্ছে না নীরা?
শুধু নিজের মনের মত স্বামী, ঘর পায় নি বলে? আর আজ কিই বা পায় নি? এত ধৈর্য্য শীল স্বামী, দ্বীনদার, শশুড় শাশুড়ি একদম যেন মা বাবার মত। আর কি লাগে একটা মেয়ের জীবনে? আমিই তো ঈশামের যোগ্য নই। এই বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যই তো আমি নই। যেখানে এত ভালবাসা, এত স্নেহ, মমতা পাচ্ছি আর সেখানে আমার স্বামী কে আমি দূরে সরিয়ে রেখেছি।
যার সাথে আমার সারাটা জিবন কাটাতে হবে তাকে দূরে সরিয়ে রেখে আমি তাকে বিষিয়ে তুলছি।
কিসের জন্য?
নীরা যেন ভাবনার দুনিয়ায় চলে গেছে।
- নীরা? এই নীরা?
- জি মা?
- জান আমার বিয়ের আগে আমার মা, দাদি, নানি কত পরামর্শ দিয়েছিল। স্বামীর সাথে কিভাবে চলব, তার কথা কিভাবে মানব, তাকে কিভাবে খুশি রাখব এসব কথা আমাকে বুঝাত। মাঝে মাঝে কথা গুলা শুনে ভীষন লজ্জা পেতাম। কিন্তু পরে এটার ভাল একটা ফলাফল পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ!
- কি রকম মা?
- শুনবে?
- হুম!
- এই ধর আমার নানী আমাকে বলত স্বামী কে ভালবাসবি। স্বামী কে ভালবাসলে আল্লাহও তোকে ভালবাসবে।
এই নিয়ে হাদিস শুনিয়ে দিত।
হযরত আলী ( রা) নবী পাক ( সা) থেকে বর্ননা করেন যে , নবী কারীম ( সা) বলেছেন, যে মহিলা তার স্বামী কে ভালবাসে আল্লাহ সে মহিলাকে ভালবাসে। হাসি খুশি এবং পর পুরুষ থেকে স্বীয় মান সম্ভ্রান্ত এর হেফাজতকারিনী মহিলাকে আল্লাহ তা'য়ালা ভালবাসেন।( কানযুল উম্মাল)।
- আপনি এটা কিভাবে এপ্লাই করেছেন?
- আমার বিয়ের পর আমার স্বামী মানে তোমার শশুড়কে ভালবেসেছি আর আমি যে তাকে ভালবাসি তাকে বুঝাতাম। লুকিয়ে রাখতাম না। বিয়ের পর আমি কোনো পরপুরুষের সাথে ইচ্ছাকৃত ভাবে কথা বলিনি। যদি না খুব প্রয়োজন হত। সেটা তোমার শশুড় বুঝতে পেত। এবং বলত- কিগো বুড়ো হয়ে গেলেও কি এত ভালবাসবে নাকি ফেলে দিবে?
আমি বলতাম- তুমি বুড়ো হলে কি আমি জোয়ান থাকব? দুই বুড়ো বুড়ি মিলেই ভালবাসব।
আলহামদুলিল্লাহ এখন প্রায় সেই বয়সেই যাচ্ছি আমরা। ভালবাসায় কোনো ফাটল ধরে নি। ইংশা আল্লাহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই থাকতে চাই।
- নীরার শাশুড়ির মুখে এরকম কথা শুনে মনে হচ্ছিল মা বাবা যেন মনে হয় ২৫/২৬ বছরের টগবগে তরুন তরুনী। কি ভালবাসার টান, কি মহব্বত!
..
- আমার মায়ের কড়া কথা! স্বামী সেবা করবি। স্বামী কি খেতে ভালবাসে তাই রান্না করে রাখবি, ওযুর পানির আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখবি, স্বামীর জামা কাপড় ধুয়ে রাখবি, অসুস্থ হলে সেবা করবি, গরম গরম খাবার পরিবেশন করবি, নামাজের সময় হলে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি। খুব ভাল ভাবে এবং কড়া করেই মা আমার মাথায় কথা গুলো ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এবং বলেছিলেন,
" হযরত ইবনে ওমর ( রা) মারফু বর্ননায় বলেন, নবী কারীম ( সা) বলেছেন- স্বামী সেবা স্ত্রীর জন্য সদকাতুল্য। ( কানয- ১৬/১৬)।
- সেই থেকে কি মা আপনি কথা গুলো পালন করে আসছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ! আমার মা বাড়িতে গিলেই জিজ্ঞাসা করত। আমি স্বামী সেবায় কোনো তারতম্য করি কিনা।
-তাই আজও আমার শশুড় আব্বা আপনাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। তাই না মা?
- হিহিহিহি! তুমি বুঝলে কিভাবে?
- একটুও আপনাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না।
- ভালই তো দেখ!
- নীরা হাসতেছে।
- জান মাঝে মাঝে তোমান শশুড় আমাকে আজাইরা কাজ করতে বলত। এই ধর, পানির কলসি টা আমি রান্না ঘর থেকে শোয়ার ঘরে নিয়ে যাব। কিন্তু ওইটা করতে দিত না। রাতের বেলায় বার বার পানি চাইত আর রান্নাঘর থেকে নিয়ে যেতে হত। বল তো একবারে পানির কলসি ঘরে নিয়ে গেলে কি হত এত কষ্ট করতে হত?
- আপনি রাগ হতেন না?
- নাহ! এই কাজটা কয়েকবার করিয়েছে। শুধু একটা পরীক্ষা নেওয়ার জন্য।
- কিসের পরিক্ষা?
- আমার নানী একটা জিনিস শিখিয়েছিলেন। স্বামীর আদেশ অনর্থক হলেও মান্য করা উচিত।
হযরত আয়েশা ( রা) হতে বর্নিত তিনি বলেন, নবী কারীম ( সা) বলেছেন- স্বামী যদি স্ত্রী কে আদেশ করে তুমি জাবালে আহমার পর্বতকে জাবালে আসওয়াদ পর্বতে নিয়ে যাও অথবা জাবালে আসওয়াদ পর্বতকে আহমারে স্থানান্তরিত কর, তাহলেও স্ত্রী যেন তা করার চেষ্টা করে। ( ইবনে মাজাহ পৃ: ১৩৪)।
দেখ তো এই হাদিসের মর্ম হল, পাহাড় স্থানান্তরিত করা কিন্তু অনর্থক। কিন্তু যেহেতু স্বামী আদেশ করেছে এটা অনর্থক হলেও স্বামীর আদেশ মানার জন্য তার চেষ্টা করতে হবে। তখনও স্বামী কে বলা যাবে না,
কি আজেবাজে কথা বলছ যা করা অসম্ভব!
নীরা! আমাকে নানী একথা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এবং আমি তা মান্য করি।
পরপর তিনদিন আমাকে এরকম করে পরীক্ষা নিয়েছিলেন তোমার শশুড়। চতুর্থ দিনে তিনি নিজেই কলসি শোয়ার ঘরে নিয়ে এসে আমাকে বলে,
- আমি সত্যিই তোমার উপর খুশি। কাজটা অনর্থক আর কষ্টের হলেও তুমি আমার কথা মান্য করেছ। আর করতে হবে না এরকম।
সেদিন থেকে তোমার শশুড় আমাকে আরো ভালবাসতে থাকে। কারন ওনার কথা আমি কখনো ফালাই নি। আলহামদুলিল্লাহ!
.
তোমাকে একটা সুন্দর হাদিসের গল্প বলি। স্বামীর আদেশের মূল্য কত এ থেকেই বুঝতে পারবে।
হযরত আনাস ইবনে মালিক ( রা) নবী কারীম ( সা) থেকে বর্ননা করেন, জনৈক ব্যক্তি ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় তার স্ত্রীকে বলে গেল:
ঘর থেকে বের হবে না।
তার পিতা ঘরের নিচ তালায় বাস করত। আর সে থাকত উপরের তালায়।
মহিলার পিতা অসুস্থ হয়ে পরলে সে লোক পাঠিয়ে নবী কারীম ( সা) এর পিতার অসুস্থতার কথা এবং স্বামীর নিষেধের কথা জানায়।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বললেন-
তোমার স্বামীর নিষেধ মান্য কর।
মহিলার পিতা ইন্তেকাল করার পর মহিলা আবার রাসূলুল্লাহ ( সা) এর নিকট লোক পাঠায়ে জানায়।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলে দিলেন,
তাকে বলো স্বামীর আনুগত্য করতে।
অতপর রাসূলুল্লাহ ( সা) মহিলার নিকট লোক পাঠিয়ে জানালেন, তুমি তোমার স্বামীর আনুগত্য করার কারনে আল্লাহ পাক তোমার পিতাকে মাফ করে দিয়েছেন।
.
- নীরা তুমি তো নামাজ পড়। তাই না?
- নীরা ইতস্তত করে বলল, পড়ি কিন্তু ফজরের নামাজ কাজা হয়ে যায়।
- না না! মোটেই কাজা করবে না। ঈশাম তোমাকে ডাকে না?
- ডাকে।
- অবশ্যই উঠবে কাল থেকে ইংশা আল্লাহ।
- জি মা।
- তুমি কি জান কাদের কাদের নামাজ কবুল হয় না আর কাদের কাদের নেক আমল আকাশে উঠে না?
- না মা! আমি এটা জানি না।
- হযরত জাবির ( রা) হতে তিনি বলেন, নবী কারীম ( সা) বলেছেন-
তিন ধরনের লোকের নামাজ কবুল হয় না। নেক আমল আকাশে উঠে না।
এরা হল:
১) পলাতক গোলাম যে পর্যন্ত সে তার মুনিবের কাছে ফিরে না আসে এবং মুনিবের হাতে হাত না রাখে।
২) যে নারীর উপর তার স্বামী নাখোশ।
৩) মদ খোর। যতক্ষন না তার মদের নেশা শেষ হয়। ( বায়হাকী শেয়াবুল ঈমান)।
- নীরার বার বার শুধু ঈশামের কথা মনে পরছে। নীরার শাশুড়ির কথা গুলো শুনে নীরার মনের ভিতর ছটফটানি শুরু হচ্ছে। আসলেই কেন ঈশামকে সে তার ভালবাসা হতে এত দূরে রেখেছে? নীরা খুবই অস্থির হয়ে উঠেছে। মনটা খুব ভারী লাগছে। কি যেন চাইছে নীরা! নীরা কি দেরি করে ফেলছে?
নীরাও যে ঈশামের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেটা বোধ হয় নীরা বুঝতে পেরেছে।
.
- নীরা! স্বামী একটা নারীর জিবনে কত বড় একটা সম্পদ তা সময় থাকতেই বুঝে নাও।
- নীরা চুপচাপ ভাবছে। মনটা তার অনেক খারাপ হয়ে আছে। মনের ভিতর শুধু এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে- নীরা কি খুব দেরি করে ফেলছে না তো?
- সব সময় তো আর সব কথা বলা যায় না। তাই আজকে এতটুকুই বললাম। নীরা?
- জি মা?
- আমার আরো কিছু বলার ছিল, এত কিছু তো একবারে বলা যায় না। ঈশামের কাছে অনেক গুলো বই আছে। ওগুলো পরবে তুমি। অনেক কিছু জানতে পারবে। বুঝছ?
- হুম।
- এই দেখ তেল দিয়ে কত সুন্দর লাগছে। আমার ছেলের সামনে অবশ্যই সেজেগুজে থাকবে। বুঝলা?
- আচ্ছা মা! নীরা শাশুড়ির দিকে মুচকি হাসি দিল।
.
নীরা আয়নার সামনে দাড়াল।
ঠিক নীরার আম্মুর মত করে নীরার শাশুড়ি তার মাথায় তেল দিয়ে দিয়েছে। তেল যেন মাথা বেয়ে মুখের দিকে আসছে। নীরা হাত দিয়ে মুখের তেল মুছে নিল। আর মনে মনে বলল-
এই তেল দেওয়ার সময় সব মায়েরাই কি এইরকম করে তেল দিয়ে দেয়?
নীরা মনে মনে হাসতেছে। মুখের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
নীরা সুন্দর করে বেনী গাঁথল। মুখের অতিরিক্ত তেল সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে তুলল।
.
বিয়ের প্রথম রাতে ঈশামের দেওয়া বই গুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। টেবিলের উপর সুন্দর করে গোছানো বই গুলো। তাছাড়া আরো অনেক বই আছে। কিন্তু নীরাকে দেওয়া বই গুলোর উপর হাত বুলাচ্ছে। বইটা খুলে বইয়ের গন্ধ নিচ্ছে। কয়েক পাতা উল্টাতেই লক্ষ করল ঈশামের গলা শুনা যাচ্ছে। বই গুলো তাড়াহুড়ো করে রেখে দিল। তারপর তার রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে দেখল, ঈশামের মা ঈশামের হাত থেকে ব্যাগ নিল।
ঈশামকে দেখল রুমের দিকে এগিয়ে আসছে।
পর্দার কাছ থেকে সরে এসে বিছানার পাশে আসল নীরা।
ধপাস করে ঈশাম বসে পড়ল বিছানায়।
কেন জানি নীরার লজ্জা লাগছে ঈশাম কে দেখে। তাকাতেও লজ্জা লাগছে। নীরা জিজ্ঞাসা করল,
- আজ খুব টায়ার্ড?
- নীরার দিকে তাকিয়ে বলল হুম।
আগে কখনও নীরা ভাল কি মন্দ জিজ্ঞাসা করে নি। আজ হঠাত কি হল?
.
ঈশাম নীরার দিকে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু নীরা তাকালে পারল না। চোখ সরিয়ে নিল নীরা।
- আজ হঠাত জিজ্ঞাসা করছ?
- এমনিতেই।
- ওহ।
.
নীরা রুম থেকে চলে গেল।
কিছুক্ষন পর আসল।
- এই নিন।
- ঈশাম নীরার হাতে পানির গ্লাস দেখে থতমত খেয়ে গেল।
- নিন বলছি? কতক্ষন ধরে থাকব।
- ঈশাম নীরার দিকে তাকিয়ে থেকেই পানির গ্লাসটা হাত থেকে নিল।
ঈশাম কিছুই বুঝল না। হঠাত নীরার কি হল?
- বিসমিল্লাহ্‌ বলে ৩ নি: শাসে ঈশাম পানি পান করে আলহামদুলিল্লাহ বলল।
মুহূর্তের মধ্যে ঈশামের ক্লান্তি যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেল।
ঈশাম শুধু ভাবছে নীরা তো কখনও আমার সাথে এরকম করে নি। আজ হঠাত?
- নীরু!
- বলেন।
- আজ হঠাত?
- জানি না কিছু। গ্লাসটা দিন রেখে আসি।
- ঈশামের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে রুম থেকে চলে গেল নীরা।
.
এদিকে ঈশাম খুব খুশি হল। আর মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ।
ঈশাম মনে মনে প্রশ্ন করছে: নীরু! তুমি কি আমার প্রেমে পড়ে গেছ?
.

পর্ব: ১৭
.
ঈশাম ঘুমাচ্ছে। এতই ঘুম দিয়েছে যে জোরে জোরে নি: শাসের শব্দ নীরার কানে ভেসে আসছে । গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঈশাম। নীরা তাকিয়ে আছে ঈশামের দিকে। এখন নীরার লজ্জা লাগছে না। কারন ঈশামের চোখ বন্ধ। যদি ঈশামের চোখ খোলা থাকত নিশ্চয় এতক্ষন নীরা ঈশামের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত না, চোখ ফিরিয়ে নিত।
.
বিছানার পাশে বইয়ের টেবিল। নীরা এক হাত বাড়িয়ে সামনে থাকা একটি বই নিল। বইটি নেড়েচেড়ে মাঝখানের পৃষ্ঠা খুলে ফেলল।
বড় বড় হেডলাইনে লিখা-
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি থাকলে স্ত্রী তার স্বামী কে সিজদা করতে হত।
নীরা এই লিখাটি দেখে তার চোখ কপালে উঠল। এমন একটি কথা এখানে লিখা?
আসলে ব্যাপারটা কি?
কৌতূহলী হয়ে নীরা পরের অংশে চলে গেল বিষয়টা জানতে।
হযরত আবু হুরায়রা ( রা) হতে বর্নিত, নবী কারীম ( সা) বলেছেন-
আমি যদি কাউকে সিজদা করার অনুমতি প্রদান করতাম তাহলে স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামী কে সিজদা করার অনুমতি দিতাম। ( তিরমিজি- ১-১৩৮)।
.
এত সম্মানিত স্বামী স্ত্রীদের কাছে?
একটা কবুল বলার পর একটা ছেলে এতই সম্মানিত হয়ে যায় একটা মেয়ের কাছে?
নীরা ভাবছে। এরপর পরতে লাগল,
হযরত কায়েস বিন সাদ ( রা) এর বর্ননায় রয়েছে যে, তিনি হিরা প্রদেশে গিয়ে দেখতে পেলেন ইহুদীরা তাদের ধর্মগুরু কে সিজদা করছে। সেখান থেকে তিনি ফিরে এসে নবী কারীম ( সা) কে এ বিষয়ে অবহিত করলেন এবং বললেন,
হে আল্লাহর রাসূল ( সা)! সিজদা পাওয়ার অধিকারি আপনিও ।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বললেন-
আমার কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময়ও কি কবরে সিজদা করবে?
আমি বললাম- না।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বললেন-
আমি যদি সিজদা করার হুকুমই করতাম তাহলে স্ত্রী কে আদেশ করতাম সে যেন তার স্বামী কে সিজদা করে। কারন আল্লাহ পাক তাদের এ অধিকার রেখেছেন। অর্থ্যাত, সম্মানের সিজদা করতে আদেশ করতাম।
( আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করতে বলা হয় নি)।
.
নীরা ঈশামের কাছে অনেক হাদিস শুনেছে। সব কাজেই হাদিস দ্বারা বুঝিয়ে দিত। এবার নীরা ঈশামের দিকে তাকাল।
কি ঘুম! ঘুমের মধ্যে যে কি স্বপ্ন দেখছে আল্লাহ জানে!
নীরা তার মুখটা ঈশামের কাছে নিয়ে গেল।
এত কাছ থেকে নীরা কখনও ঈশামকে দেখে নি।
আহা! কি মায়াবি চেহারা! চাপ দাড়ি যেন চিকচিক করছে। হালকা গড়নের মুখ। কি মমতার চাদরে পুরো মুখটা ছেয়ে আছে।
আমি এই জিনিসটা এত দিন দেখি নি। কিসের জন্য দেখতে চাই নি? এত মায়ায় কেন পরতে চাই নি?
ঈশাম? তুমি কি আমাকে কখনও ক্ষমা করবে? আমি যে তোমার প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমি কেন তা তোমাকে বুঝাতে পারছি না। তুমি যে আমার স্বামী, আমার জীবনসংগি! এটা আমার হৃদয়ে গেথে গেছে! কেন আমি তোমাকে বলতে পারছি না?
.
ঈশামের দিক থেকে মুখ টা ফিরিয়ে আবার বইয়ের পাতায় ফিরাল নীরা।
হযরত আবু হুরায়রা ( রা) নবী কারীম ( সা) থেকে বর্ননা করেন, নবী কারীম ( সা) বলেছেন, স্বামী তার স্ত্রী কে বিছানাতে আহবান করলে স্ত্রী তার আহবানে সাড়া না দিলে ভোর পর্যন্ত ফেরেশতারা উক্ত স্ত্রীর উপর লানত করতে থাকে। ( বুখারি- ২/২৮২)।
.
হাদিসটায় কি বলল?
বুঝল না নীরা! আবার পড়ল। পরতেই লাগল।
কি বলেছে হাদিসটায়?
হযরত তালক ইবনে আলী ( রা) বলেন, নবি কারীম ( সা) বলেছেন, স্বামী - স্ত্রীকে আহবান করলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে হবে। যদিও স্ত্রী চুলার পাশে বসা থাকুক না কেন।( তিরমিযি, তারগীব ৩/৩৮)।
নীরা এবার বুঝেছে। হাদিসটা কিসের ইংগিত করেছে।
নীরা তো ঈশামকে সেই অধিকার দেয়ই নি। সেখানে যদি স্বামীর ডাকে স্ত্রী সাড়া না দেয় তাহলে ফেরেশতারা লানত করতে থাকে আর নীরা ঈশাম কে তাকে ছুতে পর্যন্ত দেয় নি। তাহলে কি ফেরেশতারা আমাকে লানত করেছে? আজ বিয়ের কত দিন হয়ে গেল। কখনো ঈশাম তাকে জোর করে নি। ওই যে বিয়ের প্রথম রাতে ঈশামকে নীরা বলেছিল পারমিশন ছাড়া নীরাকে যাতে স্পর্শ না করে।
কেন নীরা এ কথা বলতে গেল? একটা মেয়েকে কতটুকু ভালবাসলে কত শ্রদ্ধা করলে একটা ছেলে এত ধৈর্য্য ধরতে পারে?
নাহ! নীরা আর কিছু ভাবতে পারছে না।
যেখানে একজন স্বামী একটি স্ত্রীর ভরন পোষন করছে, ভালবাসা দিচ্ছে, শ্রদ্ধা করছে তার কি এতটুকু পাওয়ার অধিকার নেই?
কেনই বা আমি এরকম একটা কাজ করলাম?
.
নীরা খুব অস্থির হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী ভাবল সে।
ঈশাম কি আমাকে ক্ষমা করবে? আর আল্লাহ?
নীরার চোখ দিয়ে যেন পানি গড়িয়ে পরতে চাইল।
কিন্তু নীরা সামাল দিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার অস্থির হয়ে উঠল।
দু ফোটা চোখের পানি বইয়ের কাগজে গড়িয়ে পরল।
.
নাকের পানি টানার শব্দে ঈশামের ঘুম ভেঙে গেল। কে এরকম করে কানছে এত রাতে?
ঈশাম ভাল করে চোখ খুলে দেখে পাশে নীরা নাক টানছে, চোখে পানি।
ঈশাম ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করল,
- নীরু! এই নীরু! কি হইছে?কানতেছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?
এই বলে ঈশাম নীরার মাথায় হাত দিতে যাবে তখনি সাথে সাথে ঈশাম হাত নিচে নামিয়ে ফেলল।
- কি হইছে নীরু? তুমি কি সিক?
- নীরা কিছু বলে না।
ঈশাম নীরাকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
- আরেহ ছিহ! ছোট বাচ্ছাদের মত কান্না করে! আবার দেখো নাক দিয়ে কি পরতেছে?
- নীরা হাত দিয়ে নাকের পানি মুছে ফেলল।
- এই দেখ আবার আসছে। ছিহ! এ্যা!
- আপনাকে তাকাতে বলছে কে?
- তা ওরকম করে কান্না করছ কেন?
- এমনি!
- বলা যাবে না?
- না।
- তাইলে প্লিজ নাকের পানি মুছো।
এই বলে ঈশাম টেবিলে থাকা টিস্যু দিয়ে নীরার নাক পরিষ্কার করে দিল।
- এবার বল।
ঈশাম লক্ষ করল নীরার কাছে বই। তাতে স্বামী স্ত্রীর হক, অধিকার সম্পকে লিখা আছে।
- তুমি কি বই পরে কান্না করছ?
- নীরা সায় দিল না।
ঈশাম নীরার হাত থেকে বইটা কেড়ে নিল।
পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা কে বলল,
- জানো নীরা! দুনিয়ায় যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামী কে কষ্ট দেয় তাহলে বেহেশতের স্ত্রীরা দুনিয়ার স্ত্রীকে বদ দোঅা করে?
- নীরা চুপ।
- হযরত মুয়াজ ( রা) নবী পাক ( সা) হতে বর্ননা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, কোন স্ত্রী তার স্বামী কে দুনিয়াতে কষ্ট দিলে হুরেঈন স্ত্রীরা বলে, তাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন, সে তোমার নিকট মাত্র কিছুদিন বাস করবে। অরিচেই তোমার কাছ থেকে পৃথক হয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে। ( মিশকাত, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মিরকাত ৬/৪২)।
- নীরু! তুমি কিন্ত আমাকে কষ্ট দিয়েছ!
- নীরা ঈশামের দিকে তাকাল।
- হুম সত্যিই! এই যে! রাতে একা একা কান্না করছ? আমার কোনো কাজে কষ্ট পেয়ে কান্না করছ নাকি অন্য কিছুতে তা আমি জানি না। কিন্তু ওই চোখ থেকে অশ্রু ঝড়াটা আমার পছন্দের না। বুকের বা পাশটায় ব্যাথা হয়।
- নীরা কি বলবে ঈশামকে?
- নীরু! এটা কি স্বামী কে কষ্ট দেওয়া না?
- হুম।
- তাহলে? ঘুমিয়ে যাও। না হলে শরীর খারাপ করবে।
- হুম।
নীরা শুয়ে পড়ল। ঈশাম ওদিকে ভাবছে- আমাকে কি তোমার মনের কথা কখনও জানতে দিবে না?
.
সকাল বেলা ঈশাম অফিসে চলে গেলে নীরা তার শাশুড়ির কাছে গেল। রান্না করতে ব্যস্ত উনি।
- কি নীরা? কিছু কি বলবে?
- জি মা।
- বল?
- আজ থেকে আমাকেও এই রান্নাঘরের ভাগ দিতে হবে মা!
- নীরার শাশুড়ি হাসতেছে। রান্নাবান্না পারো কি?
- শিখিয়ে দিবেন।
- তাতো দিবই। আমি অবসরে গেলে তোমাকেই তো এই সংসার চালাতে হবে তাই না।
- হ্যা মা।
নীরা শাশুড়ির সাথে কাজে হাত দিল। নীরাকে অতি যত্নে শিখিয়ে দিচ্ছেন।
নীরার একটা ইচ্ছা হচ্ছে। নিজের হাতে ঈশামের জন্য রান্না করবে। কিন্তু নীরার যে রান্না! থাক আগে শিখি তারপর সুন্দর করে রান্না করে খাওয়াব।
.
নীরা ঈশামকে ভালবেসে ফেলেছে। খুব ভালবেসে ফেলেছে। প্রথম ভালাবাসার অনুভূতি কি রকম হয় তা নীরা বুঝতে পারছে। কিন্তু ঈশামকে বলবে কি ভাবে?
এভাবে বলবে - ঈশাম আমি তোমাকে ভালবাসি; না ভালবাসি বলা টা কেমন লাগছে হঠাত করে বলা যায় নাকি ভালবাসি? এভাবে বলতে হবে যে- আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। হুম! না এভাবে বললে আবার কেমন দেখায়? উফফফফ! মেয়ে হয়ে আগে কিভাবে বলি - আমি তোমাকে ভালবাসি।
এই নাদান ঈশাম ও কিছু বলে না। আমি যে তার বউ তার তো অধিকার আছেই তো কি সে আমাকে বলতে পারে না? বোকা কোথাকার!!!!
নীরা ভাবছে ঈশামকে সে কিভাবে বুঝাবে যে নীরা ঈশামকে ভালবাসে। কোনো কিছুই যে তার মাথায় ঢুকছে না।
আচ্ছা? কাউকে ভালবাসলে বুঝি এমন হয়?
.
এর আগে কেন নীরা ঈশামকে বুঝে নি, কেন ঈশামকে এত দুরে রেখেছে? এসব যেন নীরার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে । হঠাত দরজা নক করার শব্দ। নীরা দরজার দিকে ছুটে গেল। অবশ্য আজ পর্যন্ত নীরা কেউ আসলে দরজা খুলে নি। কিন্ত আজ যেন মনই মানতে চাইছে না । নীরার শাশুড়ি দরজার দিকে আসতেই দেখল নীরা দরজা খুলতে গেছে।
নীরা দরজা খুলে ঈশাম কে দেখল। ঈশাম ভাবছে নীরা দরজা খুলল?
- মা কোথায়?
- ঘরেই আছে। কেন মাই শুধু দরজা খুলতে পারে ঘরে কি আর কেউ নেই?
- না মানে ইয়ে কখনও খোলো নি তো। তাই........
ঈশামের কথা শেষ হতে না হতে নীরা সুন্দর করে ঈশামের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিল।
ঈশাম ঘরে ঢুকার সাথে সাথে ঈশামের জুতা নীরা ঘরের ভিতর রেখে দিল।
আরেহ বাহ! ঈশাম তো পুরোই ভেবাচেকা খেয়ে গেল। এইটা কে? নীরু?
আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি?
.
- কি ভাবছেন?
- ঘোর ফিরে ঈশামের উত্তর : না না কিছু না।
- নীরা এমন একটা হাসি দিল যেন এক মাতাল হাওয়া ঈশামের মাথাটাকেই ঘুড়িয়ে দিল।
.
- ফ্রেস হয়ে খেতে আসুন।
- আচ্ছা। ঈশাম নীরার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আজ নীরার এরূপ পরিবর্তন দেখে ঈশাম যেন কিছুতেই বিলিভ করতে পারছে না। নীরা দরজা থেকে রিসিভ করল, আ লত করে ব্যাগ নিল, এমনি আমার জুতা সে তুলে ঘরের ভিতর রাখল। এ কি নীরা? আমার বউ? আমার অর্ধাঙ্গিনী?
ঈশাম আজ মনে মনে এইটা ভাবছে না যে, নীরা ঈশামের প্রেমে পড়ে গেছে কিনা। কিন্তু আজ ঈশাম মনে মনে এইটাই বলছে,
" নীরু! তুমি সত্যিই আমার প্রেমে পরেছ।"
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.