গল্প: তোমায় নিয়ে পর্ব: ১৮+১৯

গল্প: তোমায় নিয়ে
লেখাঃ সানজিদা সুরাইয়া স্মৃতি

পর্ব: ১৮+১৯




রাতের বেলা ঈশাম নীরা দুজন দুজনার বিপরীতে শুয়ে আছে।
গালের নিচে হাত রেখে নীরা জিজ্ঞাসা করল:
- আপনি আমাকে ভালবাসেন?
- ঈশাম কিছুটা থতমত খেয়ে গেল হঠাত এই প্রশ্নে। কি উত্তর দিবে সে....
- ভালবাসেন?
- ভালবাসার ডেফিনেশন নেই আমার কাছে। আর আমি ভালবাসি এটা " হ্যা" বা " না" এই শব্দ দ্বারা কখনই বুঝানো যাবে না।
- আপনার আধ্যাত্মিক কথা শুনতে চাই নি। সহজ করে প্রশ্ন করেছি সহজ করে উত্তর দিবেন।
- যদি আমি বলি অনেক ভালবাসি আমি তোমাকে, তাহলে বলেই কি হবে আর তুমি শুনেই কি করবে?
- অনেক কিছু।
- তাই বুঝি?
- আচ্ছা বলতে হবে না। বুঝে গেছি।
- কি বুঝেছ?
- ভালবাসা টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। আপনার থিওরি এটাই বলে।
- ঈশাম নীরার কথায় মুচকি একটা হাসি দিল। বলল: সবই তো জান। তাহলে জিজ্ঞাসা করলে কেন?
- এমনিতেই। ঘুমান।
- ঈশাম নীরার দিকে তাকাল।
নীরার চোখ ঈশামের দিকে পরতেই চোখ সরিয়ে নিল। তাকিয়ে থাকার সাহস নেই নীরার।
.
নীরা জানালার দিকে তাকিয়ে রাতের আকাশ দেখছে। চাদের অালো যেন তার মুখে মুক্তার দানার মত আছড়ে পরছে। কি সুন্দর রাতের আকাশ! ঝিকিমিকি করছে ওই দুরের তারা গুলো। কত ছোট ওগুলো? আসলেই কি ছোট? না। মূলত সূর্যের থেকেও বড় একেকটা। কি সুভ্র রাতের আকাশ! দেখেই যেন মনে হয় ওখান থেকে ঘুরে আসি।
চাদের বুড়ির কথা ছোটবেলায় শুনেছি। আসলেই কি ওই চাদে বুড়ি সুতো কাটে? যদি কাটত তাহলে গেলে হয়ত দেখা পেয়ে যেত নীরা!
কি ভাবছে নীরা অদ্ভুত তো? চাদে কি বুড়ি থাকে? ছোট বাচ্চাদের মত ভাবনা! নীরা মনে মনে হাসতেছিল!
ঈশাম! তুমি ভালবাসার ডেফিনেশন এর জন্য আমার প্রতি যে তোমার ভালবাসা তা বলতে পার নি। কিন্তু আমি জানি! তোমার ভালবাসার কোনো সীমা নেই। অসীম। বাউন্ডারি দিয়ে তোমার ভালবাসা যাচাই করার সাহস আমার নেই।
সেই রবের কাছে আমার চির কৃতজ্ঞতা! যিনি আমাকে তোমার জীবনসংগিনী হিসেবে দিয়েছেন।
আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!
আমি আমার রবের প্রতি সন্তুষ্ট।
.
আচ্ছা! এত সুন্দর জোসনার রাত! জোসনা বিলাস করলে কেমন হয়? চাদের অালো গায়ে মেখে নিজের সুখ দুখের কথা বললে মন্দ হয় না মোটেও। জোসনার অালোয় স্নান হয়ে যাক কিছুক্ষন।
নীরার খুব মনে চাইল সে ঈশামকে নিয়ে জোসনা বিলাস করবে। ঈশামের ঘাড়ে মাথা রেখে দুজন দুজনার গল্প বলবে। নীরা ঈশামের হাতে হাত রেখে গল্প বলবে, যার কোনো শেষ হবে না। চলতে থাকবে " হাজার বছর ধরে"........
নীরা যেন কল্পনার রাজ্যে চলে গেল ঈশামকে নিয়ে। আসলেই কি একটা মেয়ে চায় এমন? জানি না কে কিরকম চায়। কিন্তু আমার তো এমনি চাইতে ইচ্ছে করে।
নীরার এই ভাললাগার মুহূর্তটা ঈশামের সাথে ভাগবাটোয়ারা করতে চায়। নীরা জানালার দিক হতে পাশ ফিরে ঈশামের দিকে তাকাতেই দেখল-
ঈশাম ঘুমে বেহুঁশ।
.
ঈশামের ঘুম দেখে নীরার সব ইচ্ছাই যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সব আশাই যেন ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেল। মনে মনে নীরা রেগেমেগে বলল:
- এই ছেলে! এই!!! একটু না ঘুমালে কি হয় শুনি? কি সুন্দর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে! মনে হয় নাকটা চেপে ধরি!
এত সুন্দর রোমানটিক একটা মুডে ছিলাম! দিল তো নস্যাৎ করে!
পরেক্ষনেই নীরা বলল
ওর কি দোষ? আমিই তো বলছিলাম ঘুমাতে। বাধ্য ছেলে হয় এরকম বাধ্য ছেলে তাই বলে? উফফফ!!!
এই ছেলে!!!!
নীরা এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।
ঘুম ভাঙলো ফজরের নামাজের আযানে।
নীরা দেখল এখনও ঈশাম ঘুমে ।
গ্লাস থেকে পানি হাতে নিয়ে নীরা ঈশামের মুখে ঝাটকা মারল।
ঈশাম অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসল।
- কি হয়েছে নীরা?
নীরা দাত বের করে হাসতেছে।
- ঘুম শেষ আপনার?
- হঠাত পানির ঝাটকা মারলা কেন?
- বারে আপনি মারতে পারলে আমি পারব না?
- তা তো পারবে।
- জি হা! ইংশা আল্লাহ এখন থেকে এভাবেই জেগে তুলব।
- আগে তো এমন কর নি তাই বললাম আর কি।
- আগে করি নি মানে? আমার সাথে কি আপনার ৩০/৪০ বছর আগে বিয়ে হইছে যে বললেন আগে করি নি।
- আচ্ছা আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে ।
- ইট'স ওকে।
- সরিই তো বলি নি ।
এবার নীরা রেগে যাচ্ছে।
ঈশাম বলল,
- সরি নীরু!
-ইট'স ওকে।
- আমি ফজরের নামাজ পরব ইংশা আল্লাহ। আপনি মসজিদে যান।
নীরার মুখে এ কথা শুনে ঈশামের শুধু এটিই মাথায় আসছে,
" আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন তাকে সরল পথের দিকে পরিচালিত করেন। " ( বাকারাহ- ২১৩)।
ঈশাম জোরে করে বলে উঠল,
- আলহামদুলিল্লাহ!
ঈশামের অনেক ইচ্ছে করছে নীরার কপালে একটা চুমু একে দিতে। কিন্তু নীরার পারমিশন নেই। আর ঈশামও ধৈর্য্য ধারন করছে। কারন নীরার কাছে সে শুধু স্বামীই নয় সে প্রিয় বন্ধু হতে চায়। স্বামী হিসেবে সব আদায় করাই যায় কিন্তু আমি নীরার কাছে উত্তম স্বামী এবং বন্ধু হতে চাই।
- ওকে ওকে! আমি মসজিদে যাচ্ছি। জাযাকিল্লাহ খইরন। আমাকে ডেকে দেওয়ার জন্য। অনেক সময় আমি উঠতে পারি না মসজিদে যাওয়ার জন্য।
- এখন থেকে আর দেরি হবে না। আমিই জেগে দিব। ইনশাআল্লাহ।
- ঈশাম হাসি দিয়ে বলল : তুমি আমাকে পানির ঝাটকাই বা মারলে কেন?
নীরা বলতে লাগল,
" হযরত আবু হুরায়রা ( রা) হতে বর্ণিত, নবী পাক ( সা) বলেছেন, যে মহিলা রাত জেগে নামাজ আদায় করে এবং স্বামী কে নামাজ আদায় করতে জাগিয়ে দেয় সে যদি না জাগে তাহলে মুখে পানির ঝাটকা মারে। এ ধরনের মহিলাদের প্রতি আল্লাহর রহম। ( আবু দাঊদ- ১/১৮৫)।
- তুমি জানলে কিভাবে?
- বইয়ে পরেছি।
- কিন্ত এই হাদিসে কিন্ত তাহাজ্জুদ আদায়কারী মহিলার কথা বলা হয়েছে।
- দেখুন আমি অতো জানি না। যা জেনেছি তাই.....
- সেটাই এপ্লাই করেছ, তাই না?
- হুম।
- মাশা আল্লাহ। এরপর থেকে তাহাজ্জুদে ডেকে দিবা। আল্লাহ তোমাকে দ্বীনের পথে কবুল করুন। আমীন।
- নীরা ঈশামের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিল।
- যান এবার।
- ওকে!!!! ম্যাডাম!
.
ঈশাম ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে চলে গেল। এদিকে নীরা ফজরের নামাজে দাড়িয়ে গেল।
এত শান্তি? ফজরের নামাজে? আগে জানা ছিল না নীরার!
আল্লাহর কাছে দোয়া করতে করতে কখন যে নীরার চোখে পানি এল তা নীরা বুঝতে পারল না।
না! এ অশ্রু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালার ফয়সালার উপর সন্তুষ্টির। আগে নীরা তার রবকে চিনতে পারে নি। কিন্তু এখন আল্লাহ নীরাকে চিনিয়ে দিয়েছে যে, হে আমার বান্দি! আমি তোমার সৃষ্টিকর্তা! আমাকে চিনে নাও! আমিই তোমার অভিভাবক! আর আমিই তোমার জন্য যথেষ্ট!
.
ঈশাম সকাল বেলা অফিসে চলে গেছে।
আজ নীরাই ঈশামের অফিসে যাওয়ার জন্য সব রেডি করে দিয়েছে। ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া থেকে বাইরে জুতা রাখা পর্যন্ত সব করেছে।
নীরা একের পর এক কাজ করে দিচ্ছে আর ঈশাম খালি টাস্কিই খেয়ে যাচ্ছে। ঈশাম নীরার এমন চেঞ্জ কখনো কল্পনাতেও আনে নি। টাস্কি খেতে খেতেই ঈশাম অফিসের পথে রওনা হয়েছে।
.
নীরা রান্না ঘরে গিয়ে শাশুড়ি কে বলল,
- মা আজ আমি রান্না করি?
- পারবে তো?
- বলে দিয়েন একটু?
- শাশুড়ি হাসতে হাসতে বলল, কেন না?
নীরা আজ নিজের হাতে ঈশামের জন্য খাবার বানাবে। নীরার খুশি যেন ধরছেই না। কিন্ত এই খুশি মুহূর্তের মধ্যে বিলিন হয়ে যায় যখন তার মনে হয় তার তো রান্নার হাত ভাল না। কি যে হবে আজকে আল্লাহ জানে।
অনেক কষ্ট করে নীরা রান্না করল।
শশুড় এসে বলে,
- আজ নীরা মা রান্না করছে নাকি?
- জি বাবা! যেমনই হোক খেতে হবে কিন্ত?
- অবশ্যই অবশ্যই। বউমার হাতের রান্না বলে কথা!
.
- মা?
- কি নীরা?
- আমি একটা জিনিস পারি না। আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
- কি কাজ?
- আমাকে আজ শাড়ি পরিয়ে দিবেন?
- নীরার কথা শুনে শাশুড়িই যেন বেশি লজ্জা পেলেন। আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে ডাক দিও। আমি পরিয়ে দিব।
- আচ্ছা মা!
নীরা খুব খুশি মনে চলে গেল।
.
সন্ধা বেলা নীরা তার শাশুড়ির কাছ থেকে শাড়ি পরে নিল। ওইযে বিয়ের দিনে যে শাড়িটা পরেছিল সেটা।
- কি নীরা? ঠিক হয়েছে পরা?
- জি মা
শাশুড়ি হাসতে হাসতে রুম থেকে চলে গেল।
.
নীরার শশুড় শাশুড়ি রাত ৮ টার মধ্যে খানাপিনা শেষ করে খুব দ্রুতই শুয়ে পরে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না । নীরার শশুড় শাশুড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরল।
এদিকে ঈশাম এখনো কেন আসতেছে না অনেক দেরি হয়ে গেছে, নীরার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।
সে আজ নিজে রান্না করেছে ঈশামকে খাওয়াবে বলে, আজ ঈশামের জন্য সারপ্রাইজ আছে, কিন্তু এই ছেলেটা কেন আসছে না। আজ এতই বা কাজ কিসের? আজই দেরি করতে হল?
নীরা ঈশামকে ফোন দিয়ে বসল,
- আসসালামু আলাইকুম।
- ও আলাইকুমুসসালাম। নীরা?
- জি হা! আপনার বিয়ে করা বউ। এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে আপনার?
নীরার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে আসলেই পাক্কা গৃহিণী হয়ে গেছে , আহা! কি শাসন! এরকম শাসনই তো ঈশাম চেয়েছিল। তা আজ পূরন হয়ে গেল।
- হ্যালো!
- হ্যা বল নীরু?
- আপনিই বলেন এত দেরি হচ্ছে কেন?
- আজ একটু কাজ ছিল।আমি বের হয়েছি অফিস থেকে। এই তো জ্যামে পরেছি।
- ও আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসুন।
- আচ্ছা।
.
নীরা ঈশামকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করছে দেরি হচ্ছে কেন? ঈশাম কি সত্যিই এটা শুনেছে?
নীরা আমাকে সালাম দিল? আর শাসনের সুরে বলছে এত দেরি কেন?
ঈশামের তো আর মন মানে না। পারলে জ্যাম ঠেলে গাড়ির উপর দিয়ে দৌড়ে যায়, নাহলে প্যারাসুট নিয়ে উড়ে চলে যায় নীরুর কাছে।
আমার তাড়াতাড়ি বা দেরি হওয়া যার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না আজ সে কিনা আমাকে বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে বলছে। ঈশামের দিলে তো মনে হয় কয়েকটা লাড্ডু ব্রাস্ট হইছে এতক্ষনে।
.
ঈশাম ভাবছে এই ব্যস্ত শহরের মানুষ কি জানে, এই জ্যামে পরা মানুষ কি বুঝতে পেরেছে, এই লোকাল বাসে বসে থাকা মানুষ গুলো কি জানে ঈশামের মনে এত আনন্দ কেন?
কেউ জানে না।
শুধু জানে একজন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা। যিনি অন্তর্যামী।
.
রাস্তা যেন আজ ফুরোতেই চাচ্ছে না। এত তাড়াতাড়ি করছে বাসায় ফিরার জন্য আর রাস্তা যেন পিছেই যাচ্ছে।
বাস থেকে নেমে ফুটপাতের দোকান থেকে বেলি ফুলের মালা কিনল ঈশাম।
এরপর দ্রুত পদে বাসায় পৌছাতে লাগল।
বাসায় এসে দরজা নক করতেই দরজা খুলে ঈশামের চোখ তো ছানাবড়া.....................
.

পর্ব: ১৯
.
নীরা দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। লাল বেনারসি যে শাড়ি পরে নীরা ঈশামের ঘরে প্রথম পা দিয়েছিল। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক, হাত ভর্তি চুরি। নীরা আজ এত সুন্দর করে সেজেছে যে ঈশাম মুগ্ধ নয়নে অপলক দৃষ্টিতে ঢ্যাবঢ্যাব করে চেয়ে আছে।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ও আলাইকুমুসসালাম। বাইরেই থাকবা নাকি ঘরে আসবে?
- ও আচ্ছা!
নীরা ঈশামের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে জুতা ঘরে তুলল।
ঈশাম বুঝতেছে না ব্যাপারটা কি। জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না কেন এত সুন্দর করে সেজেছ।
সে যাই হোক! বউ সুন্দর করে সেজে থাকলে পরিপাটি হয়ে থাকলে, ঘরে ফিরেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
- ফ্রেস হয়ে নামাজ পরে আস আমি খাবার দিচ্ছি।
- আমি নামাজ মসজিদ থেকে পরে এসেছি।
- তাহলে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আস। আমি তোমার জন্য ভাত বাড়ছি। তাড়াতাড়িই আসবা নাইলে কিন্ত ঠান্ডা হয়ে যাবে ।
নীরার কথা শুনে ঈশাম ঘরে গেল। গিয়ে দেখল আজ বিছানায় নতুন চাদর এবং খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে নীরা। কিন্ত ঈশাম তো পুরোই কনফিউজড। বউ বেনারসি পড়া, বিছানা সাজানো, কিন্তু বিয়ে তো করছি কয়েক মাস হইল। ঈশাম মনে মনে বলল,
মে বি সামথিং, সামথিং!!!
.
ঈশাম গোসল সেরে মাথা মুছতে মুছতে খাবার খেতে আসল। ঈশাম দেখছে আজ তরকারি কেমন যেন অন্যরকম লাগছে, তরকারির ঘ্রান অন্যরকম, আর দেখতেও আগের মত লাগছে না। ঈশাম ভাবছে নীরার রান্না হবে এইটা।
নীরা খুব যত্ন করে বাড়ছে। আর ঈশাম ভ্যালভ্যাল করে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে জীবনেও দেখে নি বউকে। আসলেই তো এমন নীরাকে তো ঈশাম আগে কখনো দেখেই নি।
দুজনই ভাত নিল।
ঈশাম বিসমিল্লাহ্‌ বলে এক লোকমা মুখে দিতে যাবে আর তখনি নীরা তার হাতটা ঈশামের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
- প্রথম লোকমাটা আমার কাছ থেকে নাও।
.
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা স্বামী স্ত্রীর মাঝে এত মহব্বত, এত প্রেম, এত ভালবাসা দিয়েছে যা আর অন্য কোনো সম্পকে পাওয়া যাবে না। দুজন অপরিচিত মানুষ যারা বিয়ের আগ পর্যন্ত জানতও না যে, তারা একই ছাদের নিচে একই বিছানায় সারাটা জীবন কাটাবে। একে অপরের সুখ দুখের সাথী হবে । আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশে তারা এক হয়। কি সুন্দর একটা পবিত্র বন্ধন আল্লাহর তরফ থেকে।
.
ঈশাম দেরি না করেই নীরার হাত থেকে লোকমা খেল।
- নীরু? আমার কাছ থেকে নেবে না?
নীরা একটা মুচকি হাসি দিয়ে ইয়া বড় একটা হা করল।
খাওয়ার মাঝখানে ঈশাম বলল,
- আজকে আমার বউ রান্না করেছে?
নীরা খুব উতফুল্ল ভাবে বলল,
- হুম! হুম! আমি আমি। আমি রান্না করছি। কেমন হইছে? বলো বলো?
ঈশাম এতক্ষনে শুনতে পেল নীরা তাকে আপনি থেকে তুমি তুমি বলে সম্বোধন করছে।
- মাশা আল্লাহ। আরও ট্রাই করতে হবে।
- সত্য কথা বলার জন্য শুকরিয়া জনাব। আমিও জানি অত ভাল হয় নি।
- কিন্তু আমি তো এটা বলি নি যে, তেমন ভাল হয় নি।
- জি বুঝেছি, সেটাই বলছি, মাশা আল্লাহ বলেছ যাতে আমার রান্না আরও ভাল হয়।
- ঈশাম বলল, হুম।
.
খাওয়ার পর ঈশাম হাত ধুয়ে বসে আছে, নীরা ছোট একটা কাগজ ঈশামের হাতে গুজে দিয়ে প্লেট গুলা রান্না রুমে ধুতে নিয়ে গেল।
ঈশাম কাগজে কি লিখা আছে তা পরতে কাগজের ভাজ খুলে ফেলল। তাতে লিখা-
" আজ থেকে আর তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি আমার কাছে আসতে পার। আমাকে ক্ষমা করে দিও এত দিন তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। আজ আমাদের জন্য স্পেশাল নাইট। আর একটা কথা " আই লাভ ইউ সোনা বর- ইতি তোমার সোনা বউ নীরু"।।।।।।।।।
.
ঈশাম নীরার জন্য অপেক্ষা করছে। হাতের কাজ সেরেই আসবে সে। নীরার দেরি হচ্ছে দেখে ঈশাম কিচ্ছুক্ষণ বই পড়া যাক এজন্য টেবিলের কাছে গিয়ে বই নিতেই নীরা পিছন থেকে এসে ঈশামকে জড়িয়ে ধরল।
নীরা খুব শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে।
কিছুক্ষন পর নীরার চোখের পানি ঈশামের সাদা শার্টে লাগতেই ঈশাম বুঝতে পারল নীরা কান্না করছে। নীরার চোখের পানিতে তার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে।
ঈশাম নীরাকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনা সামনি জিজ্ঞাসা করল,
নীরু! কান্না করছ কেন? এই নীরু?
নীরু এক নিঃশ্বাসে বলল,
আমি জীবনে অনেক গোনাহ করেছি, আল্লাহ কি আমার গোনাহ মাফ করবে?
আমি আল্লাহর অনেক অবাধ্য হয়েছি, আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবে বল?
আমি অনেক নাফরমানি করেছি জীবনে, আল্লাহ কি আমার তাওবা কবুল করবেন?
আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তুমি আমার স্বামী হিসেবেও আমি তোমাকে স্বামীর অধিকার থেকে এত দিন বঞ্চিত করে রেখেছি, আল্লাহ কি ক্ষমা আমাকে করবেন?
তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে?
আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, কথায় এবং কাজে, প্লিজ আমার উপর অসন্তুষ্ট হইও না। আমি মারা গেলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবেন না।
এই জীবনে এতই গোনাহ করেছি যে আমি বুঝতে পারছি না আল্লাহ আমাকে কিভাবে ক্ষমা করবেন?
আমি পাগল হয়ে যাব! এত গোনাহ নিয়ে আমি আল্লাহর নিকট দাড়াব কিভাবে?
.
এক নাগারে নীরা কথা গুলো বলে ফেলল ঈশামকে। ঈশাম বুঝতে পেরেছে নীরা তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। এদিকে নীরার কান্নার তার চোখের কাজল ছ্যারাবেড়া অবস্থা। ঈশাম নীরাকে শান'ত করার জন্য নীরাকে বিছানায় বসিয়ে দিল।
টিস্যু নিয়ে এসে আস্তে আস্তে করে নীরার কাজল ঠিক করে দিল।
- নীরু! তোমার খোপায় কি যেন মিসিং!
- নীরা তার খোপায় হাত দিল।
ঈশাম অফিস থেকে ফিরার পথে যে বেলি ফুলের মালা কিনেছিল তা বের করে নীরার খোপায় গুজে দিল।
- এইবার পারফেক্ট!
কিন্তু নীরার চোখ দিয়ে যেন শ্রাবনের অশ্রু কিছুতেই থামছে না। নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার। ঈশাম বলল,
- আরেহ ছিহ!!! আজকেও? নাক দিয়ে কি পরতেছে!!!
- নীরা হাত দিয়ে নাকের পানি মুছে ফেলল।
- নীরু! তুমি এত গেদুর কেন? হাত দিয়ে যে মুছলা দেখ তো হাতে লাগছে না?
নীরা এইবার কান্না থামিয়ে ঈশামের দিকে চোখ রাঙালো।
ঈশাম টিস্যু দিয়ে সুন্দর করে চোখের পানি নাকের পানি মুছে দিল।
আচ্ছা কোনো স্বামী কি এই কাজ করে? ( হাউ রোমানটিক)
ঈশাম দুই হাত দিয়ে নীরার চোখ মুছে দিল।
- নীরু!
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা বলেছেন-
" নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কারী ও অপবিত্রতা থেকে যারা বেচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন। " ( বাকারাহ- ২২২)।
তুমি কি আল্লাহর কাছে তওবা করেছ?
- নীরার উত্তর : হুম।
- আলহামদুলিল্লাহ।
- তোমার প্রশ্ন হল এত দিন আল্লাহর অবাধ্য হয়েছ আল্লাহর নাফরমানি করেছ, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন কিনা? আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করবেন কিনা? তাহলে শুনো আল্লাহ কি বলেন,
" অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অত:পর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ। ( সূরা আন নিসা- ১৭)।
.
আল্লাহর কাছে তাওবা করার কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন, এবং তাওবা করার পর আল্লাহ তাকে যে ক্ষমা করবেন সেটিও আল্লাহ বলেছেন-
" তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে না কেন, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে না কেন? আল্লাহ যে ক্ষমাশীল, দয়ালু। ( মায়িদা- ৭৪)।
.
তওবা সম্পকে আল্লাহ আরো বলেন,
" যে গোনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুনাময় পায়। " ( আন নিসা- ১১০)।
" আর যারা মন্দ কাজ করে, তারপর তওবা করে নেয় এবং ঈমান নিয়ে আসে, তবে নিশ্চয়ই তোমার পরওয়ারদেগার তওবার পর অবশ্য ক্ষমাকারী করুনাময়। ( আল আরাফ- ১৫৩)।
" আমি বলছি তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নি: সন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। ( নূহ- ১০)।
.
- নীরু! তোমার প্রশ্ন আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন কিনা তার উত্তর তুমি পেয়েছ, কিন্তু আল্লাহ আরো সুসংবাদ দিয়েছেন এই তওবা কারীদের জন্য।
- নীরু বলল: কি?
- তাহলে শুনো,
" যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারন ব্যাতিত তাকে হত্যা করে না, এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখিন হবে।
কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বীগুন হবে এবং তথায় লাঞ্চিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।
কিন্তু যারা তওবা করে বিশাস স্থাপন করে এবং সতকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পূন্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
যে তওবা করে সতকর্ম করে, সে ফিরে আসার স্থান আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। ( সূরা ফুরকান- ৬৮-৭০)।
- নীরু কিছু বুঝতে পেরেছ?
- জি।
- মানে যারা তওবা করে আল্লাহ তো তাদের ক্ষমা করবেনই সাথে সাথে তাদের যে গোনাহ ছিল তা পূন্যে পরিবর্তিত করে দিবেন।
- নীরা বলে উঠল: সুবহানাল্লাহ!
- কি খুশি তো?
- আলহামদুলিল্লাহ।
.
- রাসূলুল্লাহ ( সা) কি বলেছেন জান?
- কি?
- রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, আর যে ব্যক্তি প্রায় পৃথিবী সমান পাপ করে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, অথচ সে আমার সাথে শিরক করে নি, তার সাথে আমি তত পরিমানই ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাৎ করব। ( মুসলিম- ৭০০৯)।
তার মানে এখানে কি বলা হয়েছে বল তো?
- আল্লাহর সাথে শিরক কিরা যাবে না।
- ঠিক তাই। আল্লাহর সাথে শিরক না করলে অবশ্যই আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন। তুমি কি জান? তওবাকারী ব্যক্তি তওবার পর কিরকম হয়?
- নাতো।
- বলছি, হযরত ইবাদা বিন আবদুল্লাহ তার পিতা থেকে বর্ননা করেন, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন- গোনাহ থেকে তওবা কারী গোনাহ করে নাই ব্যক্তির মত হয়ে যায়। ( ইবনে মাজাহ- ৪২৫০)।
- আরও সুসংবাদ হল, আল্লাহর ভয়ে যে কাদে জাহান্নামের আগুন তার জন্য হারাম।
- কিভাবে?
- রাসুল ( সা) বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে সে ব্যক্তি কে ( জাহান্নামের) অগ্নি স্পর্শ করা সম্ভব নয় যদিও দোহনকৃত দুধ উলানে ফেরানো সম্ভব হয়। আর জাহান্নামের ধোয়া এবং আল্লাহর পথে ( চলার কারনে) উড়ন্ত ধূলি কখনও একসাথে হতে পারে না। ( নাসায়ী- ৩১০৮)।
.

- নীরু! তুমি কার কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে?
- আল্লাহর কাছে।
- আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আছে যে বান্দার গোনাহ ক্ষমা করবে?
- নাহ।
- তাই আল্লাহ বলেন-
" তারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরন করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না। এবং জেনে শুনে তাই করতে থাকে। ( আলে ইমরান- ১৩৫)।
- জি বুঝেছি।
- কখনও নিরাশ হবে না আল্লাহর রহমত থেকে।
" বলুন! হে আমার বান্দাগন! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। ( আয যুমার- ৫৩)।
.
- আচ্ছা আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
- বল।
- মনে কর তোমার সন্তান হারিয়ে গেল তাহলে কেমন লাগবে তোমার?
- খুব কষ্ট পাব।
- আর যদি সেই সন্তান কে তুমি ফিরে পাও তাহলে কেমন লাগবে?
- দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি খুশি হব।
- হুম! ঠিক তেমনি আল্লাহ ও তার বান্দার সাথে তওবার সম্পক।
" রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন- আল্লাহ তার বান্দার তওবা করার কারনে এর চেয়ে আনন্দিত হন, কোন লোক বন জঙ্গলে তার উট হারিয়ে ফেলার পর আবার তা ফিরে পেলে যেরূপ আনন্দিত হন। ( বুখারি- ৫৮৭০)।
আল্লাহ কিন্তু এর চেয়েও খুশি হন যখম তার বান্দা বান্দি আল্লাহর নিকট তওবা করে। বুঝলা?
- হুম।
.
- নীরু! তওবা সহিহ হওয়ার জন্য ৩ টি শর্ত মানতে হবে। তুমি কি রাজি?
- ইনশাআল্লাহ।
- ১) গোনাহ করে ফেললে সাথে সাথে গোনাহের কাজটি ছেড়ে দিতে হবে। আজ থেকে করবে তো?
- জি ইংশা আল্লাহ।
- ২) ভবিষতে এই গোনাহটি না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
৩) গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
- ইংশা আল্লাহ। আমি তাই করার চেষ্টা করব।
- মাশা আল্লাহ। শুনে খুব খুশি হলাম। তুমি খুশি তো?
- আলহামদুলিল্লাহ।
- ঈশাম?
- হুম বল?
- তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ তো? আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও প্লিজ!
ঈশাম দুই হাত দিয়ে নীরার মাথা ধরে কপালে আ লত করে একটি চুমু একে দিল।
- কি নীরু? আরও কিছু? উত্তর পেয়েছ?
- নীরা লজ্জায় মাথা নীচু করে বলল : হুম।
.
কিছুক্ষন দুজনই চুপ ছিল।
ঈশাম আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে নীরাকে বলে ফেলল,
" নীরু! কিছুক্ষন পর তো ফজরেরই আযান দিবে! "
নীরা ঈশামের কথা শুনে হাত মুষ্ঠি করে ঈশামকে কয়েকটা কিল ঘুষি দিতে লাগল।
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ
.
#আজ রাত ৭ টার পর শিকলে বন্দি ভালোবাসা গল্পটির পরবর্তী পার্ট পোষ্ট করবো ইনশাআল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.