মেরাজ:এক বিস্ময়কর যাত্রা পর্ব-১

মেরাজ :এক বিস্ময়কর যাত্রা

পর্ব -১



রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের শোকের বছরের অভিজ্ঞতা গুলু যেন তখন ও তার মন ভারি করে রেখেছিল।
হইতো একটি দিন ও কাটতো না ,যে তিনি আমাদের মা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার কথা স্মরণ করতেন না।
তাঁর চাচা আবু তালিবের অনুপস্থিতি অনুভব করতেন না।
তাইফের লোকদের নিক্ষেপ করা পাথরগুলো হইতো স্মৃতির পথ দিয়ে ছুটে এসে তার অন্তরে আঘাত করত।

কিন্তু আল্লাহ তো আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
إِنَّ مَعَ ٱلْعُسْرِ يُسْرًا
উচ্চারণঃ ইন্না মা‘আল ‘উছরি ইউছরা-।
অর্থঃ নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।
এমন অকল্পনীয় পরীক্ষার পর্বের পর তার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য আল্লাহ তায়ালা উপহার স্বরূপ এমন একটি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা রেখেছিলেন যা মানব ইতিহাসে আর কারো পাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি।
সময়টা ছিল গভীর রাত ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম তার ঘরে শুয়ে ছিলেন।
হঠাৎ করে দেখতে পেলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম উপর থেকে তার দিকে আসছেন।
তিনি নবীজী সাঃ এর কাছে এসে তাকে নিয়ে গেলেন পবিত্র কাবা শরীফের হাতিম এর ভিতরে ।সেখানে তিনি রাসূল সাঃ এর বুক কেটে তার হৃৎপিণ্ড বের করে ফেলেন।এবং তা যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেন।এবং কিছু কিছু রেওয়াতে এসেছে তা ঈমান দিয়ে ধুয়ে ফেলেন।
এখানে শ্রোতাদের জন্য একটি ছোট্ট কুইজ ঠিক এরকম একটি ঘটনা রাসূল সাল্লাল্লাহু সালামের জীবনী এর আগেও ঘটেছিল আপনারা কি বলতে পারবেন সেটা কবে কোথায় ঘটেছিল?উলমাদের মতে আবারো ঈমান দিয়ে অথবা জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল তার মনটাকে শক্ত করার কারণ তিনি এমন সব জিনিস দেখতে যাচ্ছিলেন যা একজন সাধারন মানুষ তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে ।
এরপর জিবরাইল আলাইহিসসালাম তার সামনে একটা অদ্ভুত পশু নিয়ে আসলেন। যা আকারে ছিল একটি খচ্চরের এর চেয়েও ছোট।কিন্তু গাধার চেয়ে বড়। এর রঙ ছিল ধব ধবে সাদা। আর নাম ছিল আল বোরাখ।
যখন রাসূল সাল্লাহু সালাম বোরাখে চড়ে বসলেন পশু টা কিছু টা অস্থির হয়ে পড়লো। যেমন টি যে কোন পশুই নতুন কেউ চড়ে বসলে করে। তখন জিব্রাইল আলাই সালাম তিরস্কার করে বললেন তোমার কি লজ্জা হয় না ??তোমার ওপর আজ পর্যন্ত যারা চড়েছে তাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পবিত্র ব্যক্তি হলো ও।
এরপর বোরাখ রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে চলতে আরম্ভ করল ।এবং তাদের পাশে জিবরাইল আ: এবং কিছু রেওয়াত অনুযায়ী মিকাঈল আ: ও সঙ্গ দিয়েছিলেন।বোরাখ কত দ্রুত যাচ্ছিল ??রাসূল সাঃ বর্ণনা করলেন খালি চোখে যতদূর দেখা যায় বোরাখ প্রতি ধাপে ততটুকু দুরত্ব পার হয়ে যেতে লাগলো।
এই এমন গতি যা বর্তমান যুগের আধুনিক প্রযুক্তি কে ও হার মানায়। এখানে বলে রাখা ভাল। আমরা অনেক সময় শুনে থাকি রাসূল সাঃ উড়ন্ত ঘোড়ায় চড়ে ইসরা এবং মেরাজের যাত্রা সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু বাস্তবে এমন কোন রেওয়াতে বোরাখের ডানা ছিল,বা সে উড়তে পারতো এমন কোনো বর্ণনা আসেনি।
বরং বিস্মকর এই যাত্রা শুরুর প্রথম অংশ তে রাসূল সাঃ বোরাখে চড়ে ছিলেন।অর্থাৎ তিনি বোরাখে চড়ে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত গিয়েছিলেন।কিন্তু তার পরের অংশে তিনি মূলত জিবরাইল আ: এর সাথেই সাত আসমান পাড়ি দিয়েছিলেন।
অতএব বোরাখ ছিল বাস্তবে একটা পশু।এমন একটা পশু যা আমরা আগে কখনো দেখি নি।কিন্তু তাই বলে তার দুটু ডানা ছিল এবং সে উড়তে পারতো এইসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।
রাসূল সাঃ মসজিদুল আকসা তে পৌঁছে বোরাখ কে বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করলেন।সেখানে তিনি মুসা আ: কে দেখেন।যাকে তিনি বর্ণনা করেন সে নুআহ্ গোত্রের মানুষের মতো।এবং তিনি ছিলেন লম্বা ও চওড়া গঠনের মানুষ।এবং তিনি আরো দেখেন ঈসা আঃ কে।যিনি ছিলেন কর্কসিয় বর্ণের এবং তার চুল ছিলো কিছুটা ভেজা।এবং গঠনে তিনি মূসা আ:এর চেয়ে আরেকটু ছোট ছিলেন।এবং তিনি আরো দেখলেন ইব্রাহীম আ:কে।এবং রাসূল সাঃ বলেন ইব্রাহীম আ: ছিলেন দেখতে প্রায় হুবহু তারই মত।
এবং সেখানে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত নবী রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন সবাই একত্র হলেন এবং নামাজে দাড়িয়ে গেলেন। এবং তাদের ইমাম হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এরপর জিব্রাইল আ: রাসূল সাঃ এর কাছে আসলেন এবং তার কাছে দুটি পাত্র তুলে ধরলেন ।একটি পাত্রে ছিল দুধ।এবং আরেকটি পাত্রে ছিল মদ।এবং মনে রাখা ভাল যে তখন পর্যন্ত মদ্যপান হারাম করা হয়নি ।এবং জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেছেন বেঁচে নাও তোমার জন্য, এবং তোমার উম্মতের জন্য। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধের পাত্র বেঁচে নিলেন।এবং জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বললেন তুমি তোমার ফিতরা অনুযায়ী বাছাই করেছো ।
এর পর রাসূল সাঃ এর বিস্ময়কর এই যাত্রার প্রথম পর্ব ইসরা শেষ হয়। এবং দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় যাকে বলা হয় মেরাজ।
রসূল সা দেখলেন তার জন্য জন্য আকাশ টা উন্মুক্ত হয়ে গেল ।এবং তিনি জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এর সাথে আকাশ পানে ভ্রমণ করতে লাগলেন।অনেক উলামাদের মতে আমরা আমাদের মহাবিশ্ব বলতে যা কিছু বোঝায় অগণিত সব গ্রহ ,উপগ্রহ ,এবং নক্ষত্র দিয়ে সাজানো এই প্রকান্ড জগৎ এই সব কিছুই প্রথম আসমানের অংশ।কেননা আল্লাহ তা'আলা সূরা মূলকে বলেন
وَلَقَدْ زَيَّنَّا ٱلسَّمَآءَ ٱلدُّنْيَا بِمَصَٰبِيحَ
উচ্চারণঃ ওয়া লাকাদ ঝাইয়ান্নাছ ছামাআদ্দুনইয়া- বিমাসা-বীহা
অর্থঃ আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জত করেছি।
এরমানে এই মহাবিশ্বে যতদূর পর্যন্ত নক্ষত্র রয়েছে অন্তত ততদূর পর্যন্ত প্রথম আসমানের বিস্তার।অকল্পনীয় এই দূরত্ব জিব্রাইল আ:এর সাথে পাড়ি দিয়ে রাসূল সাঃ পৌঁছে গেলেন দ্বিতীয় আসমানের দ্বারপ্রান্তে।
এবং সেখানে যাওয়ার পর দ্বিতীয় আসমানের রক্ষী ফেরেশতারা তাদের পরিচয় জানতে চাই।জিব্রাইল আ:বললেন আমি জিব্রাইল।তখন তারা বলে তোমার সাথে কি কেউ আছে?তিনি বললেন হ্যা।আপনার সাথে আছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
উত্তরে প্রশ্ন আসে, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? এবং জিবরাঈল আ: বললেন হ্যা।এরপর দ্বিতীয় আসমানের দরজা খুলে যায়।এবং এই দরজা কেমন,কিভাবে খোলে, কতটা প্রকাণ্ড তা আমাদের কল্পনার বাইরে।
আমরা শুধু এতোটুকু জানি, যে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আমরা কখনো প্রথম আসমান থেকে দ্বিতীয় আসমানে যেতে পারবো না। নতুন এই জগতে প্রবেশ করার সাথে সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম দেখলেন তার জন্য একজন লম্বা মতো ব্যাক্তি অপেক্ষা করছেন ।
জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেন ইনি তোমার বাবা আদম।উনাকে সালাম দাও।রাসূল সাঃ আদম আ: কে সালাম দিলেন। এবং তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন।মারহাবান বিল ইবনে সালেহ্ , উয়া নাবিয়্যূ সালেহ্।স্বাগতম হে পবিত্র সন্তান।হে পবিত্র নবী।
এরপর নবীজী সাঃ জিবরীল আ:এর সাথে সাত টি আসমান একে একে পাড়ি দিলেন।এবং প্রত্যেকটি আসমানের দ্বারপ্রান্তে ফেরেশতারা তাদের পরিচয় জানতে চাই। এবং পরিচয় জানার পর তাদের জন্য সে আসমানের দরজা খোলে তাদের স্বাগত জানায় ।
এবং প্রত্যেকটি আসমানে আল্লাহ রাসূল সাঃ কে সম্ভাষণ জানানোর জন্য একজন নবী বা রাসূল পাঠিয়েছিলেন।এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে একে একে দেখা করেন ইয়াহইয়া এবং ঈসা আঃ,ইউসুফ আ: যাকে দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তাকে যেন সৌন্দর্যের এক অর্ধেক দিয়ে দেয়া হয়েছিল ।ইদ্রিস আ:,হারুন আ:,মূসা আ: এবং অবশেষে সপ্তম আসমানে পৌঁছে তার দেখা হলো ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সাথে ।যিনি বায়তুল মামূরের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন ।এবং ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও আদম আলাইহিস সালামের মতো রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম কে বললেন মরহাবান বিল ইবনে সালেহ্,উয়া নাবিয়্যু সালেহ্ ।
এই পর্বের ঘটনা গুলু থেকে কয়েকটি পয়েন্ট লক্ষণীয় ,প্রথমত আখেরাতে নবী-রাসূলদের অবস্থান উচ্চতর স্থানে ।রসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে স্বাগত জানানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা এক একজন নবীকে এক একটি আসমানে পাঠিয়েছেন মাত্র ।
আমরা যেনো কেউ মনে না করি আদম আলাইহিস সালাম এর অবস্থান ঈসা আঃ এর নিচে,ঈসা আঃ এর অবস্থান ইউসুফ আলাই সালাম এর নিচে,,,,, নাঊযুবিল্লাহ।
আল্লাহ আমাদের কে আখেরাতে নবী-রাসূলদের সাথে জান্নাতের উচ্চতর স্থানে থাকার তৌফিক দিন। দ্বিতীয়ত রাসূল সাঃ তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর অধ্যায় পাড় করার পর এই যাত্রায় এমন সব নবীদের সাক্ষাৎ পেলেন যাদের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে যেন আল্লাহ তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে কিছু ব্যাপারে শিক্ষা দিচ্ছিলেন।
প্রথমেই তিনি দেখা করলেন আদম আলাই সালাম এর সাথে ।যাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল জান্নাতে বাস করার জন্য। কিন্তু তাকে জান্নাত ছেড়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু সেই প্রস্থান চিরস্থায়ী ছিল না। তিনি আবারও জান্নাতে ফিরে গিয়েছিলেন ।
তেমনিভাবে ঈসা আলাইহিস এবং ইয়াহিয়া আ: সালাম কে তাদের নিজেদের মানুষেরাই হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। একইভাবে ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন যাকে তার আপন ভাইয়েরা হত্যা করার চেষ্টা করেছিল ।
একে একে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সব নবীদের এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন যারা প্রত্যেককে কোন না কোন বড় পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন।
এবং তাদের জীবনী থেকে যেনো রাসূল সাঃ শান্তনা পেলেন। অনুপ্রেরণা পেলেন।
জীবনের পরীক্ষাগুলো যতই বড় হোক না কেন সেগুলো কেটেই যাবেই।ভালো দিন আসবেই।
এবং ভবিষ্যতে যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা ছাড়তে হলো তিনি যখন মদিনা থেকে ইসলাম প্রচার করলেন অবশেষে তিনি যখন বিজয়ী হয়ে মক্কায় ফিরলেন এবং মক্কায় ফিরে যারা তার বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে তিনি কি বললেন??
তিনি সেই কথা গুলু বললেন যা বহু যোগ আগে ইউসুফ আ: তার ভাইদের বলেছিল ,যখন তারা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে ইসলামে ফিরে আসতে চেয়েছিল আজকে তোমাদের উপর কোনো পাপ নেই।
আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন ।নবীজি সাল্লাল্লাহু সালামের বিস্ময়কর এই যাত্রা বাকি অংশে তার এমন আরও আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা হলো যা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর ।
সে ঘটনা গুলু আগামী পর্বে বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।



কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.