গল্প: তোমায় নিয়ে পর্ব: ১০+১১



গল্প: তোমায় নিয়ে
লেখাঃ সানজিদা সুরাইয়া স্মৃতি

পর্ব: ১০+১১



নীরা কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়ি বেড়াতে যায়। সেখানে গিয়ে ওয়্যারড্রপে কাপড় চোপড় গুছাতে গুছাতে নীরার চোখে পড়ল দুইটা হিজাব। ভার্সিটির বান্ধবীরা খুব সুন্দর করে, স্টাইল করে হিজাব বাধে মাথায়। তাদের দেখেই শখ করে ২ টা হিজাব কিনেছিল। কিন্ত আগে তো হিজাব পরার অভ্যাস ছিল না তাই আর পরা হয় নি। নীরা ব্যাগে হিজাব দুইটা ভরে নিল। শশুড় বাড়িতে নিয়ে যাবে। এখানে রাখলে জিনিস পরেই থাকবে। সবে নীরা বাবার বাড়িতে আসছে তিনদিন হল। এরই মাঝে ঈশাম বারবার ফোন দিয়ে বলছে তার কাছে যেতে। বাবার বাড়িতেও থাকতে দিবে না?
- আসসালামু আলাইকুম নীরু।
- ও আলাইকুমুসসালাম। বলেন। আর যাই বলেন, আমি কিন্ত কয়েকদিন এইখানে থাকব। যাইতে বলবেন না।
- আমার ভাল লাগছে না। আস তুমি।
-বললাম না! যাইতে বলবেন না।
- আমি নিতে আসব তোমাকে কাল ইংশা আল্লাহ। রেডি থাইকো।
এই বলে ঈশাম ফোন কেটে দিল।
নীরা বিষয়টা খুবই ইনজয় করছে। ঈশাম আর নীরার মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পক এখনও স্থাপন হয় নি। তাতেই ঈশাম নীরাকে ছেড়ে থাকতে চায় না। নীরা এত দিনে বুঝে গেছে ঈশাম নীরাকে খুবই ভালবাসে। তানাহলে একটা ছেলের এত ধৈর্য্য কিভাবে হতে পারে? এত শ্রদ্ধা? দুনিয়াতে এখনও এরকম ছেলে আছে ঈশামকে না দেখলে কখনওই বিলিভ হত না । নীরা ঈশামকে না নিয়ে যেতে বললেও নীরা ইচ্ছাকৃত ভাবে বলেছে, তাকে যেন এখনি না নিয়ে যায়। কিন্তু মন থেকে বলে নি । নীরা দেখতে চেয়েছিল সত্যই ঈশাম আসে কি? আর কত দিন নীরাকে ছেড়ে থাকতে পারে।
.
পরের দিনই ঈশাম মহাশয় হাজির নীরাকে নিতে। খাওয়া দাওয়ার পরই নীরাকে নিয়ে রওনা হল।
- কোথায় যাচ্ছেন?
- বাসায় ফিরার আগে কোথাও ঘুরে আসি চল।
- না বাসায় চলেন।
- উহু। না। বউকে নিয়ে ঘুরব।
.
ঘুরাঘুরির এক পর্যায়ে ঈশাম নীরাকে বলল কি খাবে?
- নীরা সাথে সাথে উত্তর দিল ফুচকা।
- আর কিছু?
- নাহ।
ঈশাম ফুচকার অর্ডার করল।
নীরার ফুচকার পাগল এককথায় যাকে বলে। নীরা ১ প্লেট আর ঈশাম ১ প্লেট খাওয়া শুরু করল। নীরার খুব কষ্ট হচ্ছিল নিকাবের নীচ দিয়ে খেতে। কিন্তু তবুও সে নিকাব খুলে নি। ঈশাম নীরাকে নিয়ে এক কোণে বসল যাতে নীরা আরামে খেতে পারে আর মানুষের আড়াল হয়।
১ প্লেট....
২ প্লেট.....
২.৫ প্লেট ফুচকা সাবার করল নীরা। ঈশামের প্লেটে আরও ৩ টা ছিল সেটাও মুখে পুরে নিল। কিন্তু আড়াই প্লেট এর পর আর পারল না।
ঈশাম শুধু নীরুর দিকে তাকিয়ে ছিল। আর নীরার খাওয়া দেখে খালি ঢোক গিলছিল।
.
বাসায় আসার পর যা হওয়ার তাই হল। নীরার বমি আর পেট খারাপ।
- আচ্ছা? মানুষ খায় তাই বলে আড়াই প্লেট ফুচকা একবারে? তাও আমার টাও খাইছ?
- চুপ থাকেন! আবার বমি আসতেছে বালতি নিয়ে আসেন।
- আনছি আনছি।
- আরও খাবা?
- কি?
- ফুচকা?
- আপনার মাথা খাব! বলছি না চুপ থাকতে! মনে পড়লেই খারাপ লাগছে। ওইটার কথা বলবেন না!
- আচ্ছা! আচ্ছা বলব না।
.
পরের দিন....
- নীরু! কেমন লাগছে?
- আগের থেকে ভাল।
- আজকেও খাবা ফু...........( ঈশাম নিজের মুখ চেপে ধরল)।
- কিহ?
- না কিছু না।
- রেস্ট নাও।
.
অনেক ট্রাই করছে কিছুতেই হচ্ছেনা। কতবার ট্রাই করল, তাও হচ্ছে না। মেয়েরা বাধে কিভাবে?
নীরা প্রায় ১ ঘন্টা ধরে হিজাব বাধার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অবশেষে কোনো মতে এচিয়ে পেঁচিয়ে মাথায় শত ভাজ দিয়ে হিজাব পরল। আহা! কি কষ্ট! পরতেই পারছিলাম না! তাও হইছে কিছুটা।
.
ঈশাম অফিস থেকে ফিরে নীরাকে দেখল নীরা মাথার উপর ১৪ তালা বিল্ডিং বানিয়ে হিজাব পরেছে। মাথার পিছনে ইয়া বড় একটা খোপা। মনে হচ্ছে বাধা কপির স্তর মাথায় পরেছে। ফ্রেস হয়ে নীরাকে ডাকল ঈশাম।
- কি পরছ মাথায় ওইটা।
- দেখেন না? হিজাব। অনেক কষ্টে পরছি। পারছিলামই না পরতে। মেয়েরা যে কি সুন্দর করে বাধে!
- হুম! বাঁধাকপি বাধে মাথায়। খায় তো না! কি আর করবে? এজন্য মাথায় মাখে।
- কেন? সুন্দর তো লাগে।
- তোমরা যে কি সৌন্দর্য খুজে পাও তা আমার জানা নেই। কিন্তু এরকম করে ফ্যাশন করলে জান্নাত তো দূরে থাক জান্নাতের সুগন্ধও যে নসিব হবে না।
- কেন? তারা তো মাথা ডাকছে। চুল দেখানোর গুনাহ কম হচ্ছে।
- পর্দা কি শুধু চুলের? আর দেহের পর্দা নেই? লজ্জা কি শুধু চুলেই? বক্ষে নেই?
- হুম পর্দা তো সব অঙ্গেরর আছে। কিন্তু এখানে ভুল কোথায়?
- তোমাকে ক্লিয়ার করে দিচ্ছি বস এখানে।
নীরা বসে গেল।
.
হযরত মুহাম্মাদ ( সা) বলেছেন- দুটি দল জাহান্নামী, তাদের আমি কখনও দেখি নি।
এদের একটি দল এমন, যাদের হাতে সর্বদাই চাবুক থাকে যা দেখতে গরুর লেজের ন্যায়, তা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করে। ( অর্থ্যাত যারা সর্বদাই অন্যায়ভাবে মানুষের উপর যুলুম করে)।
আর অন্যটি নারীর দল, যারা অর্ধনগ্ন অবস্থায় কাপড় পরিধান করে। ফলে তারা লোকদের অাকৃষ্ট করে এবং তারাও দুষ্ট লোকদের দ্বারা অাকৃষ্ট ও ব্যাভিচারের শিকার হয়। তাদের মাথা যেন উচু কুজবিশিষ্ট চলন্ত উটের ন্যায়। এরা কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে। ( মুসলিম- ২১২৭)।
আর যারা এই হিজাব পরার মাধ্যমে বলে বেড়ায় তারা পর্দা করছে, তাহলে যেনে রাখ এগুলা স্রেফ তামাশা ছাড়া আর কিছুই না। রং ঢং করে কখনও পর্দা হয় না। তারা হিজাব পর্দার নামে যা করছে এতে পর্দার অপমান করা হবে। পর্দা হতে হবে শরীয়াত সম্মত! পর্দা নিয়ে কোনো রং তামাশাত স্থান নেই ইসলামে। এটা আল্লাহর ফরজ বিধান। হুকুম আহকাম! এটা নিয়ে মশকরা করার আগে এটার পরিনাম কি ভয়াবহ তা জানতে হবে। বুঝেছ নীরু?
- নীরা আস্তে আস্তে হিজাব খুলল। মাথায় উচু করে করা খোপা খুলে চুল ছেড়ে দিল।
.
ঈশাম নীরার খোলা চুল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
- কি হল? কি দেখেছেন?
- না মানে ইয়ে। ক্ষুধা লাগছে । ভাত খাব।
নীরা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল।
ঈশাম বেআক্কেল এর মত ঠায় দাড়িয়ে রইল।
.
রাত ১টা।
সারা শহর ঘুমের রাজ্যে ঢলে পরেছে। সোডিয়ামের বাতিগুলো জলছে রাস্তায়। অালোর কাছে পোকা গুলোও যেন খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রাস্তায় চলছে গোটা দুয়েক ট্রাক, মাঝে মাঝে ভো ভো করে ফাকা রাস্তা দিয়ে চলে যায়। তারপর আবার নিস্তব্ধতা যেন জেকে বসে। ছাদের কোনে দাড়িয়ে ঈশাম দেখছিল ব্যস্ত শহর ঘুমের কাছে যেন পরাজিত সৈনিক। ঘুম নেই যেন ঈশামের চোখে। নির্ঘুম চোখ জোড়া দিয়ে ঈশাম এই শহর টাকে দেখছে। মনে হয় যেন কত আপন, তারপই মনে হয় এসব কিছুই না ।
দীর্ঘ এক নি: শাস ফেলে আকাশের পানে চায় ঈশাম। কি নির্মল, কি স্বচ্ছ! সুবহানাল্লাহ! কি সৃষ্টি তোমার হে আল্লাহ! মৃদু হাওয়ায় যেন ভেসে যেতে ইচ্ছে করে রূপকথার সেই চাদের দেশে। কত বিশাল আকাশ? কত বড় জমিন!
নীরু! তোমার মনে কি আমার জন্য খানিকটা জায়গা নেই? আমার রাজ্যে শুধুই তুমি। আমার পৃথিবীতে শুধু তোমার অানাগোনা। কিন্তু তোমার রাজ্যে আমার ঠাই কোথায়? তোমার পৃথিবীতে কি আমার জন্য একটু জায়গা দিতে পার? যেখানে হৃদয়ের জমে থাকা ভালবাসার বীজ বপন করতে পারি, যত্ন করতে পারি! পারো না নীরু! আমার হৃদয়ের মনি কোঠায় শুধু তুমিই। ঠিক বুকের বা পাশটায়। তোমার রাজ্যের দুয়ার খুলবে কবে? আমি যে দাড়িয়ে আছি অনেক ভালবাসা নিয়ে। তোমার কি সময় হয় নি? কেন এত অপেক্ষা করাও। আমি কি তোমার ভালবাসার পরশ পেতে পারি না? উত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহন কর। স্বামী, বন্ধু যেটাই ভাব সেটাই আমি।
.
রাতের চাদটাও আর ভালো লাগছে না। ঘরে আমার চাদ আছে, অালোকিত করে রেখেছে, কিন্তু কোথায় যেন এক অপূর্ণতা! কোথায় যেন এক না পাওয়ার হতাশা! কোথায় যেন এক বুক শূন্যতা। কিছুতেই যেন তা পূর্ণ হয় না। হাহাকার করছে পাওয়ার জন্য। ঈশাম ভাবতে ভাবতে যেন খেই হারিয়ে ফেলল।
.
ঘোর ভাঙলো মশার কামড়ে। পায়ের কাছে শত শত মশা। ১০ টা তাড়ালে ১০০০ টা আসে। ধুত! এখানে আর থাকাই যাবে না। মশার অত্যাচারে ঈশাম ছাদ থেকে রুমে ঢুকল।
সোনা বউয়ের ঘুমন্ত মুখ যেন পূর্নিমার অালোকেও হার মানায়। কি অপরূপা! মাশা আল্লাহ! কি মায়ায় আচ্ছন্ন! আচ্ছা? পৃথিবীর সব স্বামীর কাছেই তো তাদের স্ত্রী রূপসী! অবশ্যই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা এই পবিত্র বন্ধনটাকে কতই না মধুর করেছে, কতই না সুদৃঢ় করেছে। এই বন্ধনের যেন কোনো তুলনাই হয় না। আমার সোনা বউ পৃথিবীর সেরা সুন্দরী।
.
ঈশাম নীরার দিকে মুখ করে এক হাতের উপর শুয়ে আছে। নীরাকে দেখেই যাচ্ছে!
হঠাত নীরা কাত ফিরবে, এরই মাঝে একটু চোখ খুলল! চোখটা খোলার সাথে সাথে দেখল ঈশাম ট্যালট্যাল করে চেয়ে আছে। ভয়ে এক চিতকার করে উঠল! নীরার চিতকারের শব্দে ঈশাম এক লাফে বসে পরল।
- নীরু! কি হয়েছে? অমন করে উঠলে কেন?
- আপনি ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন এত রাতে?
- তোমাকে দেখছিলাম।
- দেখার আর সময় পান না?
- সব সময়ই দেখি।
- এই ভর দুপুর রাতে ভুতের মত চেয়ে আছেন! ভয় লাগে না! বুকটা ধুক ধুক করছে!
- কই দেখি কোথায় ধুক ধুক করছে?
- কিহ! ফাযিল!
- বারে! বউয়ের হৃদপিন্ডের শব্দও শুনতে পারি না?
- লাগবে না। আপনি শুয়ে পরুন। আর বলেন আপনি কেন তাকিয়ে ছিলেন?
- জানতে চাও?
- হুম।
- তাহলে শুন,
" যখন স্বামী স্ত্রী একে অপরের প্রতি প্রেম ও মহব্বতের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করেন, আল্লাহ তা'য়ালা ও তাদের উভয়ের প্রতি রহমতের দৃষ্টি বর্ষণ করেন। "( বুখারি- ৬১৯)।
তুমি তো আমার দিকে তাকাও না তাই কাজটা আগে আমিই শুরু করেছি। আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি চাই। তাই।
- নীরার গলা ধরে এল। কিন্তু সামলে নিল।
- বুঝেছ সোনা বউ?
- ঘুমান এখন। কাল অফিসে যাবেন না নাকি ।
- তাহাজ্জুদ পরে ঘুমিয়ে যাব ইংশা আল্লাহ! তুমি পরবে?
- আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
ঈশাম কিছু বলল না। আচ্ছা! বলে অযু করতে গেল।
.
শুক্রবার, ঈশামের অফিস বন্ধ। ঈশামের মা ঈশামের জন্য মুরগির মাংস রান্না করেছে। খুব প্রিয় ঈশামের। জুমুঅার নামাজ শেষে দুপুরে খেতে বসেছে ঈশাম আর নীরা।
- মা! বাবা কই?
- তোর বাবা ঘরে শুয়ে আছে।
- খাবে না?
- নামাজ পরে এসেই খেয়ে নিয়েছে। খুব নাকি ক্ষুধা পেয়েছিল। তাই খাইয়ে দিয়েছি।
- তুমি খাবে না।
- তোর বাবার সাথেই খেয়েছি । একা নাকি খাবে না। তোরা শুরু কর। আমি যাই তোর বাবার কিছু যদি লাগে।
নীরা কথাগুলা শুনল ঈশামের মায়ের মানে তার শাশুড়ির। অনেক কেয়ার করে শশুড়কে।
ঈশাম এক গাল হাসি দিতে খাওয়া শুরু করল। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে । দুজনই খাওয়া শুরু করল। নীরারও মুরগী অনেক পছন্দের।
খাওয়ার এক পর্যায়ে ঈশাম নীরার হাত থেকে মাংসের হাড্ডিটা কেড়ে নিল।
.

পর্ব: ১১
.
- নীরা বুঝলা না কি হল।
- ওদিকে নীরার গোশতের হাড্ডি ঈশাম কট কট চিবিয়ে খাচ্ছে।
- এই যে! আপনি আমারটা কেড়ে নিলেন কেন?
- তোমারটা নিয়েছি আর কারও টা নেই নি।
- নিলেন কেন? দেখছেন না আমি খাচ্ছিলাম আর আমার এটা অনেক পছন্দের।
- আমার আরও পছন্দের একটা কাজ বউ এর এটো করা গোশতের টুকরা খাওয়া।
- মানে? আপনি আমার এটো করা খাবার খাবেন কেন?
- খাবই বা না কেন? যেখানে রাসূলুল্লাহ ( সা) ওনার বিবির এটো করা খাবার খেয়েছেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ ( সা) এর উম্মাত! কেন আমি এইটা করতে পারব না আমার বউ এর সাথে। মহব্বত বৃদ্ধি পায়।
" আমি ( আয়েশা) পান করে পাত্রটা নবিজী ( সা) এর দিকে বাড়িয়ে দিতাম। তিনি আমার এটো করা স্থানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন। দাত দিয়ে গোশত ছিড়ে খাওয়ার পর আমার লালা লেগে থাকা স্থানেই তিনি মুখ লাগিয়ে খেতেন। ( মুসলিম)।
কি রোমানটিক ছিলেন আমাদের প্রিয় নবীজি ( সা)! রোমান্টিকতাও শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের। কি চমতকার না?
- হুম!
খাওয়া শেষে নীরা পানি খেল। পানির গ্লাসটা রাখতে না রাখতেই ঈশাম গ্লাসটা হাতে নিয়ে নীরা যেখানে মুখ লাগিয়ে খেয়েছিল ঠিক সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করল।
নীরা কিছুই বলল না। কারন কিছু বলারও ছিল না। শুধু ঈশামে মুগ্ধ হয়েছিল।
- ওই! নীরু!
- ( চমকে উঠে) কি?
- কি ভাবতেছ?
- কই কিছু না তো।
- আজ সন্ধায় ইংশা আল্লাহ হাটতে যাব। সো এখন একটু রেস্ট নাও।
খাওয়ার পর ঈশাম বিছানায় শুয়ে পরল। নীরাও বিছানার পাশে এসে বসে পরল। নীরা এখন কেমন জানি ভাবুক হয়ে গেছে। সারাদিন কি যেন ভাবে আর মাঝে মাঝে দীর্ঘ নি: শাস ফেলে। সারাদিন ভাবনার জগতে বিচরন করে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
.
মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর দুজনই বাহিরে বের হল।
- কেথায় যাচ্ছেন?
- চল! দেখা যাক আল্লাহ কোথায় নিয়ে যায়। কেন তোমার খারাপ লাগছে?
- না।
- চল কিছু দূরে একটা পার্ক আছে ওখানে হাটার জায়গা আছে। মূলত হাটার জন্যই করা হয়েছে। চল!
.
ঈশাম আর নীরা দুজন পাশাপাশি হাটছে। দুজন দুজনার পাশাপাশি, ব্যবধান শুধু দুই বিঘত পরিমান। আশেপাশে অনেকেই আছে স্বামী স্ত্রী আসছে হাটতে। হাত ধরে তারা হাটছে। ঈশামের এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে হাটছে। কিন্তু নীরা দেখছে চারদিকে তাকিয়ে।
- নীরু! ছুটির দিন তো তাই আজ একটু ভীর বেশি। সবাই তার পরিবার পরিজনকে নিয়ে আসছে। আসলে সবাই সারা সপ্তাহ অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই ছুটির দিন গুলোতে পরিবার আর স্ত্রীকে সময় দিতেই মাঝে মাঝে ঘুরতে এবং হাটতে আসা। ব্যস্ত কর্মজীবন! সারা জীবন কাজের পিছনে পরে থাকলেই হয় না! পরিবার পরিজনদেরও হক আছে । তাদেরও সময় দিতে হয়। না হলে একটা গ্যাপ পরে যায়। এই যে দেখ! কত স্বামী স্ত্রী, পরিজনকে নিয়ে আসছে, হাটছে, কথাবার্তা বলছে! সারা সপ্তাহের জন্য একটা রিফ্রেশমেন্ট!।
" নবিজি ( সা) সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন
ফাকে ফাকে স্ত্রীদেরকে সময় দিতেন। তবে রাতের বেলায়, চারদিক নিরব হয়ে এলে, তিনি আয়েশা ( রা) এর সাথে ঘুরতে বের হতেন। হাটতে হাটতে কথাবার্তা বলতেন। ( বুখারী)।
আর আমরা আজ সভ্য সমাজে বাস করি। নিজের পরিবারকে সময় না দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বন্ধু বান্ধবদের সাথে অযথা আড্ডাবাজিতে মত্ত থাকি, ফেসবুকে ওত পেতে থাকি সারাক্ষণ। পরিবারের লোকদের সময় দেওয়ারই সময় হয় না।
জানো নীরু! রাসূলুল্লাহ ( সা) স্ত্রীদের সাথে খেলাধুলাও করতেন?
" আয়েশা ( রা) বলেছেন- একবার নবিজি ( সা) আমাকে বললেন : চলো দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমরা দৌড়ালাম। আমি তার চেয়ে এগিয়ে থেকে দৌড় শেষ করলাম। কিছুদিন পর আমার স্বাস্থ্য একটু ভাল হলে, তিনি আবার একদিন প্রতিযোগিতা দিতে বললেন। এবার তিনি জয়ী হলেন। মুচকি হেসে বললেন: এটা সেটার বদলা। শোধবোধ! ( আবু দাউদ)।
ঈশাম হাদিসটা বলার পর মুচকি হাসল। নীরা খেয়াল করল।
- জানো! এটা আমার কাছে অনেক ভাল লাগে হাদিসটা । নীরু! দৌড় প্রতিযোগিতা করবে?
- এখন? এখানে? কিভাবে সম্ভব?
- তাই তো! কি বলব বল! ঢাকা শহরে কোথাও মানুষ ছাড়া হাটার জায়গা নেই। কিন্তু ইচ্ছে ছিল দৌড় দেওয়া তোমার সাথে। দেখতাম কে জিতে।
- নীরা হাসতেছিল।
- ঈশামও নীরার সাথে সেই হাসি।
.
আজ নীরার ফাইনাল এক্সাম শুরু। সকাল বেলা নীরা রেডি হল। নীরার উদ্দেশ্য পরীক্ষার ১ ঘন্টা আগে গিয়ে পৌছাবে। কারন জ্যামের ভিতর পরলে সমস্যা আর তাছাড়া কখন পৌছাবে এত টেনশন নীরার ভাল লাগে না। তাই সিদ্ধান্ত যে ২ ঘন্টা আগে বের হয়ে যাবে। কতক্ষন লাগে লাগুক। ১ ঘন্টা আগে গেলেই হল।
- নীরু! তুমি কি রেডি? চল খেয়ে রওনা দেই।
- জি আমি রেডি।
ঈশাম নীরাকে দেখার সাথে সাথে নীরার জামা থেকে অতি সুগন্ধি পারফিউম ঈশামের নাকে এল।
- নীরা!
- হুম!
- পারফিউম দিও না। পারফিউম দিয়ে বাহিরে যেতে পারবে না। যাও গোসল করে আস।
- আমি তো রেডি হয়ে গিয়েছি। এখন গোসল করব? সময় তো চলে যাচ্ছে। আর কেন পারফিউম দিতে পারব না? শরির ঘেমে গন্ধ বের হওয়া আমার পছন্দ না। যাতে কোনো গন্ধ না হয় সেজন্য আমি দিয়েছি। আর দিলেই বা কি সমস্যা?
- অনেক সমস্যা। নারীদের সুগন্ধি ব্যবহার করে বাহিরে যাওয়ার অনুমতি নেই। যদি ঘামের কারনে শরিরে গন্ধও হয় তবুও না। সেজন্য নিয়মিত কাপড় পরিষ্কার আর শরিরের যত্ন নিতে হবে যেন শরীর থেকে কোনো দুর্গন্ধ না বের হয়।
- কেন মানা সুগন্ধি ব্যবহার নারীদের জন্য?
.
মহানবী ( সা) বলেছেন- সুগন্ধি ছড়াবার উদ্দেশ্য কোন মহিলা যদি তা ব্যবহার করে পুরুষদের সামনে যায়, সে ব্যভিচারিণী। ( আবু দাউদ, মিশকাত - ১০৬৫)।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেন, যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে যাবে সে মহিলার গোসল না করা পর্যন্ত কোনো নামাজ কবুল হবে না। ( ইবনে মাজাহ- ৪০০২)।
রাসূল ( সা) বলেন, আল্লাহর বান্দীদেরকে মসজিদে আসতে বারন কর না, তবে তারা যেন খুশবু ব্যবহার না করে সাধাসিধে ভাবে আসে। ( আবু দাউদ)।
রাসূলুল্লাহ ( সা) আরো বলেছেন- প্রত্যক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর মহিলা যদি ( কোন প্রকার) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোন (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী। ( তিরমিযি- ২৭৮৬)।
.
সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো মহিলা মসজিদেও যেতে পারবে না। একদা চাশতের সময় আবু হুরাইয়া ( রা) মসজিদ থেকে বের হলেন। দেখলেন একটি মহিলা মসজিদে প্রবেশে উদ্যত। তার দেহ বা লেবাস থেকে উতকৃষ্ট সুগন্ধির সুবাস ছড়াচ্ছিল।
আবু হুরাইয়া ( রা) মহিলাটির উদ্দেশ্য বললেন, আলাইকিস সালাম।
মহিলাটি সালামের উত্তর দিল।
তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন- কোথায় যাবে তুমি?
সে বলল- মসজিদে।
বললেন- কি জন্য এমন সুন্দর সুগন্ধি মেখেছ তুমি?
বলল- মসজিদের জন্য।
বললেন- আল্লাহর কসম?
বলল- আল্লাহর কসম।
পুনরায় বললেন- আল্লাহর কসম?
বলল- আল্লাহর কসম।
তখন তিনি বললেন- তবে শোন, আমাকে আমার প্রিয়তম রাসূল ( সা) বলেছেন যে, সেই মহিলার নামাজ কবুল হয় না, যে তার স্বামী ছাড়া অন্য কারো জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করে। যতক্ষন না সে নাপাকির গোসল করার মত গোসল করে নেয়। অতএব তুমি ফিরে যাও, গোসল করে সুগন্ধি ধুয়ে ফেল। তারপর ফিরে এসে নামাজ পড়। ( ( আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)।
.
শুধু স্বামীর জন্য মহিলারা সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে।
নীরা আর দেরি না করে গোসলে ঢুকল। তারপর রেডি হয়ে পরিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য বের হল।
.
কিছুদিন পর......
ঈশাম হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরল।
ঈশামের মা ঈশামকে জিজ্ঞাসা করল,
- কিরে আর এত তাড়াতাড়ি আসলি যে?
- মা একটা খবর আছে।
- কিরে?
- বড় খালু মারা গেছেন।
- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কখন?
- ১২ টার কিছু পরে।
- আর দেরি করিস না আমাকে নিয়ে চল।
.
ঈশাম, নীরা, মা, বাবা সবাই বড় খালার বাসায় গেল। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। কে কাকে সান্ত্বনা দিবে?
ঈশামের খালা এদিকে কান্নাকাটি করছে বুক চাপড়িয়ে, বিলাপ করে। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে।
ঈশাম মাকে ডেকে বলল
- মা! খালাকে একটু বুঝাও। এভাবে কান্নাকাটি করতে নিষেধ কর। এরকম করলে মুর্দার কষ্ট হয়। উনি কি এটাই চান? ওনাকে যাও বুঝাও। বিলাপ করে কান্না করতে নিষেধ কর।
ঈশামের মা খালার কাছে গিয়ে অনেক্ষন ধরে বুঝালেন। অনেক পরে খালার ক্রন্দনের আওয়াজ একটু কমে আসল।
.
নীরা ঈশামকে ডেকে বলল
- মানুষ মারা গেছে, কান্না তো আসবেই। আপনি কান্না করতেতে মানা করলেন কেন?
- আমি কান্না করতে মানা করি নি। কিন্তু খালা যেভাবে কান্না করছিল আসলে ওভাবে কান্না করা ইসলামে জায়েজ না, নিষিদ্ধ, কঠোর ভাবে নিষেধ আছে।
আত্নীয় স্বজনদের ইন্তেকালে গভীর মর্মব্যাথায় যে অশ্রুধারা বয়ে চলে তাতে দোষের কিছু নেই। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। রাসূলে কারীম ( সা) ছাহেবজাদা ইব্রাহীম ( রা) এর ইন্তেকালে এতই শোকার্ত হয়ে উঠেন যে, তার দুই গন্ডে অশ্রুধারা বইতে থাকে। এ সম্পকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন-
" এটাতে মন্দের কিছু নেই। বরং এটা গভীর মমত্ববোধের পরিচয়বাহী।
অতপর বলেন,
চক্ষু অশ্রুসিক্ত, অন্তর শোকার্ত, তবে মুখে তাই বলব যা আল্লাহর পছন্দ, অর্থ্যাত, ইন্না লিল্লাহি........ রাজিউন, হে ইব্রাহীম! তোমার বিচ্ছেদে আমি শোকে আমি সন্তপ্ত। ( বুখারী)
.
উম্মে আতিয়াহ ( রা) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, বাই'আতের সময় নবী ( সা) আমাদের কাছে এই অঙ্গীকার গ্রহন করেছেন যে, মৃতের ব্যক্তির জন্য মাতম করব না। ( বুখারি- ১৩০৬)।
মু'আবিয়া ( রা) হতে বর্নিত, তিনি হিমস নামক স্থানে ভাষনদানকালে তার ভাষনে উল্লেখ করেন যে, " রাসূলুল্লাহ ( সা) বিলাপ করে কাদতে নিষেধ করেছেন। ( ইবনে মাজাহ ১৫৮০)।
আবু হুরাইয়া ( রা) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুল ( সা) বলেছেন, দু টো স্বভাব মানুষের মাঝে রয়েছে, যার কুফর বলে গন্য,
১) বংশে খোটা দেয়া।
২) মৃতের জন্য মাতম করে কান্না করা। ( মুসলিম- ১২১-(৬৭), তিরমিজি- ১০০১)।
ইবনে আব্বাস ( রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন,
মৃতের জন্য বিলাপ করা জাহিলী প্রথা। ( ইবনে মাজাহ- ১৫৮২)।
অন্য হাদিসে আছে,
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রা) হতে বর্নিত, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন,
যারা ( মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলে এবং জাহিলী যুগের মত চিতকার করে, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। ( বুখারি- ১৩৯৪, তিরমিজি- ৯৯৯)।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, মাতমকারিনী মহিলা যদি মরনের পূর্বে তওবা না করে, তাহলে আলকাতরারর পায়জামা এবং পাঁচড়ার জামা পরিহিতা অবস্থায় তাকে কিয়ামতের দিনে দাড় করানো হবে। ( মুসলিম- ১৫৫০)।
অন্য হাদিসে বর্ণনায় এসেছে,
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, বিলাপকারিনী তওবা না করে মারা গেলে আল্লাহ তা' য়ালা তাকে আলকাতরা যুক্ত কাপড় এবং লেলিহান শিখার বর্ম পরাবেন। ( ইবনে মাজাহ - ১৫৮১)।
রাসূল ( সা) ক্ষতবিক্ষতকারিনী, বক্ষদেশের জামা ছিন্নাকারিনী, ধ্বংস ও মৃত্যু কামনাকারিনী ও শোকগাথার অায়োজনকারিনীকে অভিসম্পাত করেছেন। ( ইবনে মাজাহ- ১৫৫৮)।
.
নীরা এবার বুঝেছ?
- হুম।
- আচ্ছা নীরা আমি যদি মারা যাই তাহলে তুমি কি আমার জন্য একটু কান্না করবে?
.
( চলবে ইন শা আল্লাহ

কোন মন্তব্য নেই

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

konradlew থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.